সুন্নাহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


সুন্নাহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা
  إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের খারাবী থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নাই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হেদায়েত দেয়ার কেউ নাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোন শরিক নাই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা কিয়ামত পর্যন্ত সঠিকভাবে তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় বান্দাদের প্রতি অধিক দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তার বান্দাদের যে কোন উপায়ে ক্ষমা করতে ও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পছন্দ করেন।

 এক- সূন্নাহের অনুসরণ করার কোন বিকল্প নাই। কিন্তু সূন্নাহের অনুসরণ করতে হলে, সূন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান থাকাও জরুরী। কোনটি সূন্নাহ আর কোনটি বিদআত তা জানা না থাকলে, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করা যেমন কঠিন হবে তেমনি বিদআতকে সূন্নাহ আর সুন্নাহকে বিদআত বলে চালিয়ে দেয়া হবে। তখন সূন্নাহ যেমন কলুষিত হবে, অনুরূপভাবে ইসলামী শরীয়তে বিদআতের অনুপ্রবেশের ফলে শরীয়তের মূল ভীত দুর্বল হয়ে পড়বে, দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি ঘটবে। আসল দ্বীন আর অবশিষ্ট থাকবে না। যেমনি ভাবে পূর্বেকার নবীদের দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি ঘটেছিল। এ বাস্তবতা আমরা যুগ যুগ ধরেই প্রত্যক্ষ করছি। কারণ, আমরা দেখি কিছু আমল এমন আছে যেগুলোকে মানুষ ইবাদাত হিসেবে করে আসছে এবং সূন্নাহ বলে জ্ঞান করছে, অথচ তা কখনোই সূন্নাহের অন্তর্ভুক্ত নয়। এর মুল কারণ হল, সূন্নাহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান না থাকা এবং সূন্নাহ ও বিদআতের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে অক্ষম হওয়া।
দুই- সূন্নাহ ও বিদআত কি তা জানা না থাকার পরিণতি যে কত ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি কোন অশিক্ষিত বা সাধারণ শিক্ষিত মানুষ এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে তা যদিও আশ্চর্যের বিষয় নয়। কিন্তু যখন দেখতে পাই সুপরিচিত মুফতি, মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদিসরাই ইসলামের এ মৌলিক বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। যারা ইসলামের ধারক হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত যাদের অনুসরণ করে মানুষ দ্বীন শিখবে তাদের মধ্যে দ্বীনের জ্ঞান না থাকা, ইসলামের সঠিক আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে তাদের মধ্যে ভ্রান্তি থাকা শুধু দু:খ জনকই নয়, বরং এটি দ্বীন ও ইসলামের জন্য মারাত্মক হুমকি। আমাদের এ উপমহাদেশে এ সমস্যাটি খুবই প্রকট। এখানে যারা ইসলাম সম্পর্কে পড়া লেখা করে তারা নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে পড়া লেখা করার সুযোগ খুব একটা পায়না এবং তাদের শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষা পদ্ধতিও সনাতন। তাদের সিলেবাসে যে সব কিতাবাদি পড়ানো হয়ে থাকে, তা যদি কেউ ভালোভাবে পড়ে তাহলে সে তা থেকে কোন প্রকার আরবি গ্রামার, মানতিক, বালাগাত ইত্যাদি শেখার সুযোগ পাবে বটে; কিন্তু মূল দ্বীনি শিক্ষা কুরআন ও হাদিসের ইলম এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের বাণী-হাদিস সম্পর্কে শিক্ষা লাভের সুযোগ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যথেষ্ট সীমিত। ফলে দেখা যায়, ‘দাওরায়ে’ হাদিস বা ‘কামিল’ পড়ার পর একজন ছাত্রকে আলেম বা মাওলানা বলা হয়ে থাকে এবং সেও মনে করে আমি একজন আলেম বা মাওলানা। অথচ দেখা যায় সে যে শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়া লেখা করেছে, তার মধ্যেঅনেক ছাত্রই এমন আছে, যারা তাদের ক্লাসের নির্ধারিত কিতাবগুলোই ভালোভাবে বোঝেনি। এ ধরনের ওলামা ও মাওলানারা দীর্ঘ সময় বিভিন্ন শিক্ষকদের সংশ্রবে থেকে তাদের মুখ থেকে যে সব কথা শুনেছে, তাদের থেকে যে সব ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ গ্রহণ করেছে, সেটাই তাদের ইলম এবং সেটিই তাদের আদর্শ ও দ্বীন। এর বাইরে তারা কোন কিছু শোনতে বা শিখতে রাজি না। চাই সেটা কুরআন হাদিস হোক বা না হোক। তারা মনে করে, এর বাইরে কিছু শিখতে গেলে, জানতে গেলে আমরা গোমরাহ হয়ে যাব এবং তাদের ওস্তাদরাও তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবত এ ধারণাই দিয়ে আসছে- খবরদার! তোমরা আমাদের কথার বাইরে যাবে না। ফলে এদের পরিণতি হয় এমন; এদের কাছে যদি আপনি কোন সঠিক কথাও তুলে ধরেন বা হাদিসের কোন সু-স্পষ্ট বাণীও তুলে ধরেন, তারা কখনোই তা গ্রহণ করবে না। তারা মনে করে, এ কথা আমার ওস্তাদ-তো বলেননি বা আমার ওস্তাদ কি কম জানতেন?। ফলে দেখা যাবে, নিজেকে একজন আলেম দাবি করা সত্ত্বেও সে কথাটি কুরআন ও হাদিসের কষ্টি পাথরে যাচাই করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। আর এ ধরনের আলেমরাই যখন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বীনি দায়িত্ব পালন করেন, তাদের থেকে সমাজ কি পায় বা তারা সমাজকে কি দিতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের তথাকথিত আলেমদের অধিকাংশই কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা রাখে না এবং কুরআন হাদিস থেকে কোন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার যোগ্যতা তাদের না থাকার কারণে তারা ইসলামের আলো থেকে অন্ধকারেই অবস্থান করে। যারা তাদের অন্ধ ভক্ত ও অনুসারী তারাও ইসলামের মূল জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণা থেকে অনেক দূরেই থেকে যায়। বর্তমান সমাজে সূন্নাহ পরিপন্থী কার্যকলাপ-বিদআত ও কু-সংস্কারসমূহ চেপে বসার এটি একটি অন্যতম কারণ।

 

তিন- ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত সবাই যে কুরআন ও হাদিস বুঝতে সক্ষম নয় সে দাবি আমি করছি না। বরং তাদের মধ্যে কতক এমনও আছেন যারা নির্ধারিত সিলেবাস পড়ার পর ইসলামী জ্ঞান-কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেন এবং কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে গবেষণা করে থাকেন। তবে এদের সংখ্যাও খুব নগণ্য। কিন্তু তাদের সমস্যা হল, তাদের চিন্তা চেতনা ও গবেষণা সব কিছুই হয়ে থাকে অন্ধ অনুকরণ, সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামির উপর ভিত্তি করে। তাদের কাছেও তাদের মুরব্বী ও মাজহাবী মতাদর্শের ব্যতিক্রম কোন কিছুই গ্রহণ যোগ্য নয়। তারা তাদের লালিত আদর্শ ও ওস্তাদদের থেকে গৃহীত ধ্যান-ধারণার বাহিরে কোন কিছু মানতে রাজি না। তাদের মাজহাবিয়্যতের সামনে বিশুদ্ধ হাদিস ও সূন্নাহ একেবারে গুরুত্বহীন। তারা মনে করে মাজহাবিয়্যাত ধ্বংস মানে হচ্ছে, ইসলাম ধ্বংস। ফলে এ শ্রেণির লোকের মধ্যেও ইসলামের মূল দলীল – কুরআন ও সূন্নাহ-আড়ালেই থেকে গেল। কুরআন সূন্নাহ হতে ইসলামকে গ্রহণ করার স্বাদ হতে এরাও দূরেই সরে রইল। আবার অনেক এমন আছেন তারা নির্ধারিত সিলেবাস পড়ানোর পর শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়ে একই কিতাব পড়াতে থাকেন এবং তার চিন্তা চেতনা এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি যদি সিলেবাসের কিতাবগুলো ভালোভাবে পড়াতে পারেন, তাহলেই তিনি বিজ্ঞ আলেম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। কুরআন হাদিস সম্পর্কে তারপ্রকৃত জ্ঞান না থাকা তার জন্য বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস হওয়ার ক্ষেত্রে কোন ক্রমেই প্রতিবন্ধক নয়। অথচ কুরআন হাদিসের সঠিক জ্ঞান ছাড়া সত্যিকার আলেম, মুফতি ও মুহাদ্দিস হওয়া সম্ভব নয়।

 

চার- সূন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এটি শুধু কোন কিছু না জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এর অর্থ হল, ইসলাম সম্পর্কেই না জানা বা অজ্ঞ থাকা। কারণ, সূন্নাহ ছাড়া ইসলামের কথা চিন্তাই করা যায় না। কুরআন যেমন ইসলামী শরীয়তের মূল ভিত্তি অনুরূপভাবে সূন্নাহও ইসলামী শরীয়তের মুল ভিত্তি। সূন্নাহকে বাদ দিয়ে শুধু কুরআন থেকে অথবা কুরআনকে বাদ দিয়ে শুধু সূন্নাহ থেকে ইসলাম জানা আকাশ কুসুম সমতুল্য। কুরআন ও সূন্নাহ থেকেই ইসলাম জানতে হবে এবং এ দুটিকে ইসলামের মানদণ্ড বলে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, কুরআন যেমনি ভাবে অকাট্য দলীল হিসেবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে, হাদিস কিন্তু আমাদের কাছে অকাট্য দলীল হিসেবে পৌঁছেনি। কুরআনে যেমন কোন প্রকার অবকাশ নাই হাদিস কিন্তু সে পর্যায়ের না। অনুরূপভাবে কুরআনের ক্ষেত্রে সহীহ, হাসান, দুর্বল ও বানোয়াট বলার কোন অবকাশ নাই কিন্তু হাদিস তা নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই এ বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছেন, তিনি বলেন, শেষ যুগে কতক মিথ্যুক দজ্জালের আগমন ঘটবে, তারা তোমাদের কাছে এমন সব হাদিস পেশ করবে, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষরাও কখনওশোনেনি, অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যাও, তারা যেন তোমাদেরকে ভ্রষ্টতা ও ফিতনা-ফ্যাসাদে নিপতিত করতে না পারে। হাদিসের ক্ষেত্রে সহীহ, হাসান, দুর্বল ও বানোয়াট যেহেতু আছে, তাই ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য হাদিসের এ বিষয়গুলো জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এ বিষয়গুলো জানা না থাকে তাহলে ইসলাম সম্পর্কে নিরেট জ্ঞান লাভ আদৌ সম্ভব নয়। জ্ঞানহীন আমল বা অন্ধানুকরণ ইসলামী আদর্শের বিপরীত মেরু ও প্রতিপক্ষ। আমল করার জন্য কোন হাদিসটি সহীহ আর কোন হাদিসটি দুর্বল আর কোনটি মাওজু বা বানোয়াট তা জানা থাকা খুবই জরুরি। এ সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই একজন মানুষ তার আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ইসলামী শরিয়তের বিধান মেনে চলতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে মানুষের মধ্যে সূন্নাহ সম্পর্কে বিষয়টি না জানা থাকাতে আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। কোন আমলটি কোন পর্যায়ের তা তারা অনুধাবন করতে পারে না। বিষয়টি যদি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে হত, তাহলে তা খুব একটি দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হল, তথা কথিত আলেম, ওলামা, পীর মাশায়েখরাও যখন এ সম্পর্কে জ্ঞানহীন হয়, তাহলে মুসলিম জাতির গতিবিধি কি হতে পারে তা চিন্তাই করা যায় না। অজ্ঞতার ফলে বর্তমানে সমাজে আমরা দেখতে পাই সহীহ আমলের বিপরীতে অসংখ্য ভিত্তিহীন আমল স্থান পেয়েছে। সঠিক ও নির্ভুল কথার বিপরীতে কাল্পনিক, শোনা কথা, বানানো কথাগুলো স্থান পেয়েছে। নকল ভেজালটাই বাজারজাত হয়ে আছে। তার বিপরীতে খাঁটি কথা, খাঁটি আমল মূল্যহীন। তার কোন স্থানই নাই। অবস্থা এতই অবনতির দিকে গিয়েছে, আপনি যদি বলেন, তুমি এ কথাটা কোথা থেকে বললে, অথবা তুমি যে এ আমল করছ তার প্রমাণ কি? তাহলে আপনাকে বলবে, তুমি প্রমাণের কি বুঝ? আমাদের বাপ-দাদা, পীর-মাশায়েখ, মুহাদ্দিস ও মুফতিরা কি কম বোঝেন? তারাওতো আলেম বা তারাও দাওরা/কামিলপাশ। এখানেই শেষ নয়, বরং আপনাকে উল্টো গোমরাহ বলে চুপে করিয়ে দেবে। আপনাকে বিভিন্ন ধরনের ভৎসনা করবে। আপনার বিরুদ্ধে তারা ফতোয়া গ্রহণ করবে। কিন্তু দু:খের বিষয় হল, যারা ফতোয়া দেবেন, তারা তথাকথিত জ্ঞানী নামধারীরাই, যাদের কাছে মূলত: কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান বলতে কিছুই নাই।

মুসলিম উম্মাহর এ দূরাবস্থার কারণে তাদের সূন্নাহ সম্পর্কে সচেতন করা এবং সূন্নাহের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের অবগত করা খুবই জরুরি। এ বইটিতে সূন্নাহের গুরুত্ব এবং সূন্নাহ বিষয়ে কুরআন হাদিস ও উম্মতের ইজমা কি তা আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রার্থনা এই যে আল্লাহ যেন আমাদের কুরআন সূন্নাহর উপর চলা ও তদুনুযায়ী জীবন যাপন করার তাওফীক দেন। আমীন।
সংকলক
জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের।
প্রথম অধ্যায়

সুন্নাহর পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং কুরআনের সাথে সুন্নাহর সম্পর্ক

প্রথম পরিচ্ছেদ

সুন্নাহর পরিচয়

সুন্নাহ [سنة] শব্দটি মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত পরিভাষা, কিন্তু শব্দটি আরবি হিসেবে তার আভিধানিক ও পারিভাষিক একাধিক পরিচয় হতে পারে। নিম্নে সুন্নাহর আভিধানিক ও পারিভাষিক বিভিন্ন পরিচয় তুলে ধরা হল।

সুন্নাহর আভিধানিক অর্থ: মিসবাহুল মুনীর গ্রন্থকার তার স্বীয় গ্রন্থে বলেন, সুন্নাহ [سنة] শব্দটির আরবি আভিধানিক অর্থ হল:  الطَّرِيْقَةُ অর্থাৎ, পথ ও পদ্ধতি,চাই সেটি ভালো হোক বা খারাপ হোক। আর সুন্নাতের অপর অর্থ َالِّسيْرَة অর্থাৎ আদর্শ ও রীতিনীতি, চাই সেটি খারাপ হোক বা ভালো হোক। মোট কথা, সুন্নাহ[السنة] -এর আভিধানিক অর্থ হল পথ ও পদ্ধতি, আদর্শ ও রীতিনীতি চাই তা ভাল হোক অথবা খারাপ হোক।

আর মুফরাদাত গন্থের প্রণেতা গরীবুল কুরআনে উল্লেখ করেন, السنن শব্দটি سنة শব্দের বহু বচন। আর রাসূলের সুন্নাত, এ কথার অর্থ রাসূল আদর্শ যা তিনি পালন করতেন। আল্লাহর সুন্নাত এ কথার অর্থ, আল্লাহর পথ ও পদ্ধতি, তার হিকমত এবং তার আনুগত্যের নিয়ম ও পদ্ধতি। “সুন্নাহ” এ অর্থেই কুরআন ও হাদিসে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِكُمۡ سُنَنٞ فَسِيرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَٱنظُرُواْ كَيۡفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلۡمُكَذِّبِينَ ١٣٧ ﴾ [ال عمران: ١٣٧]
“তোমাদের পূর্বে অতীত হয়ে গেছে অনেক ধরণের জীবন পদ্ধতি, রীতি ও নীতি। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ- যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে[1]।”
অত্র আয়াতে سُنَنٌ শব্দটি [سنة] সুন্নাহ এর বহুবচন, এ শব্দটি এখানে জীবন পদ্ধতি ও রীতি-নীতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখিত আয়াত ছাড়াও কুরআনুল করীমে এরূপ বহু আয়াতে একই অর্থ সূন্নাহ শব্দটি এসেছে।  যেমন-
 ﴿ فَهَلۡ يَنظُرُونَ إِلَّا سُنَّتَ ٱلۡأَوَّلِينَۚ فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَبۡدِيلٗاۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَحۡوِيلًا ٤٣﴾ [فاطر: ٤٣]
তবে কি এরা প্রতীক্ষা করছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত পদ্ধতির? কিন্তু আপনি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখনও কোন পরিবর্তন পাবেন না এবং আল্লাহর পদ্ধতির কোন ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করবেন না। [সূরা ফাতির: ৪৩] অর্থাৎ পদ্ধতি অথবা স্বভাব বা রীতি, যার উপর ভিত্তি করে রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী-বিরোধীদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বিধান জারি হয়; সুতরাং, তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার বিধান হল: তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা এবং তাদের কর্তৃক রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদেরকে শাস্তির মাধ্যমে পাকড়াও করা।
সুন্নাহ [سنة] শব্দটি একই অর্থে হাদিসেও বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-
 عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا فِي جُحْرِ ضَبٍّ لَاتَّبَعْتُمُوهُمْ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى؟ قَالَ: فَمَنْ؟  [رواه مسلم]
অর্থ, সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির রীতি-নীতি বিঘতে-বিঘত, হাতে-হাত অর্থাৎ হুবহু অনুসরণ করবে, এমনকি তারা গুই সাপের গর্তে প্রবেশ করলে তোমরাও তাদের অনুসরণ করে একই গর্তে প্রবেশ করবে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ববর্তী জাতি বলতে কি ইয়াহুদ ও নাসারা? তিনি বললে, তাহলে আবার কারা?।[2]
এ হাদিসে لتتبعن سنن এর মধ্যে سنن শব্দটি সুন্নাহ [سنة] অর্থাৎ ”রীতি-নীতি ও জীবন পদ্ধতি” অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এরূপ আরও বহু হাদিসে এসেছে।
অতএব সুন্নাহ [سنة] শব্দটি কুরআন, হাদিস ও আরবি ভাষায় “রীতি-নীতি, পথ ও পদ্ধতি” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই অধিকাংশের নিকট এটাই সুন্নাহ [سنة]এর আভিধানিক অর্থ।

সুন্নাহর পারিভাষিক অর্থ:

আল্লামা ইবনুল আসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেনে, ইসলামি শরীয়তে যখন সাধারণভাবে সুন্নাহ [سنة] শব্দটি ব্যবহার করা হবে, তখন এর অর্থ দাঁড়াবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ, নিষেধ কথা, কাজ ও সম্মতি ইত্যাদি; যে সব বিষয় সম্পর্কে আল্লাহর কিতাব কোন প্রকার বর্ণনা দেয়নি; শুধু রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। এ জন্যই শরীয়তের দলীল সমূহের ক্ষেত্রে বলা হয় যে, কিতাব ও সুন্নাহের দলীল, অর্থাৎ কুরআন ও হাদিসের দলীল। তবে পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শাস্ত্রের বিদ্বানগণ স্বীয় উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ভঙ্গিতে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাতে সূন্নাহের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও সূন্নাহের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে মৌলিক কোন পার্থক্য নাই।
আল্লামা শাতবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বিশেষ করে যে সব বিষয়গুলো কুরআনে বর্ণিত নয়, কেবল মাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত, শরীয়তের সে সব বিষয়গুলোকে সুন্নাত বলে।
কেউ কেউ বলেন, শরীয়তের পরিভাষায় সুন্নাত হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত নফল ইবাদাত। আবার কখনো সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত এমন সব দলীলকে সুন্নাত বলা হয়, যার তিলাওয়াত করা হয় না, যা কুরআনের মত মুজিযার অন্তর্ভুক্ত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা, কর্ম ও সম্মতি এরই অন্তর্ভুক্ত।
এতে প্রমাণিত হয়, যখন সুন্নাত শব্দটি ব্যবহার করা হয়, তখন তার দ্বারা তিনটির যে কোন একটি অর্থ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
১- কুরআনের মোকাবেলায় সুন্নাত, তখন তার দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কর্ম ও তার সম্মতি।
২- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব কাজ করেছেন এবং তা তিনি সর্বদা করেছেন, রাসূলের অনুকরণে সে সব কর্ম করার উপর সাওয়াব দেয়া হবে এবং ছেড়ে দেয়ার উপর শাস্তি দেয়া হবে না, তাকে সুন্নাত বলে।
৩- বিদআতের বিপরীতে সুন্নাত শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে সব কথা, কর্ম ও সম্মতি  কুরআন ও সুন্নাহ- রাসূলের কথা, কর্ম ও সম্মতির- সাথে সাংঘর্সিক হবে না, বরং কুরআন সুন্নাহের মুয়াফেক হবে, তাকে সুন্নাত বলে। চাই বিষয়টির উপর কুরআন ও হাদিসের সরাসরি দলীল থাকুক বা কুরআন ও হাদিসের মূলনীতি হতে দলীলটি গ্রহণ করা হোক। পক্ষান্তরে যে সব কথা, কর্ম ও সম্মতি কুরআন ও সুন্নাহের পরিপন্থী হবে, তাকে বিদআত বলে।
মুহাদ্দিস তথা হাদিস শাস্ত্রবিদদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কথা, কাজ, সম্মতি এবং সৃষ্টিগত ও চারিত্রিক গুণাবলী যাহাই প্রমাণিত হয় সবই সুন্নাহ বলে পরিচিত। এই দৃষ্টিকোণ হতে অনেক মুহাদ্দিসের নিকট সুন্নাহ ও হাদিস একই বিষয়। উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
ফিকাহ শাস্ত্রের নীতিমালা তথা ওসূল শাস্ত্রবিদদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআন ছাড়া ইসলামের দলীল যোগ্য কথা, কাজ ও সম্মতি যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে সবই সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। ফিকাহ্ শাস্ত্রবিদদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ফরয ও ওয়াজিব ছাড়া যে সমস্ত বিধান সাব্যস্ত হয়েছে তা সবই সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। আবার বলা হয় যা করলে ছাওয়াব হবে কিন্তু ছুটে গেলে শাস্তি হবে না তাহাই সুন্নাহ।
বিদ্বানগণের উদ্দেশ্য ভিন্নতার কারণে সংজ্ঞার ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। উপরোক্ত সংজ্ঞা সমূহের মধ্যে মুহাদ্দিসদের সংজ্ঞাটি ব্যাপক অর্থ সম্বলিত, অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত কথা, কাজ, সম্মতি এবং সৃষ্টিগত ও চারিত্রিক গুণাবলী সবই সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত।
অবশ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত গুণাবলী সুন্নাহ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিনা সে ব্যাপারে কিছু একাধিক মতামত পরিলক্ষিত হয়। তাই এ ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী [রাহিমাহুল্লাহ]-এর সুন্নাহর সংজ্ঞাটি যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি বলেন:
السنة في الإصطلاح: هى ما صدرعن النبي من قول أو فعل أو تقرير مما يراد به التشريع للأمة، فيخرج بذلك ما صدر عنه من الأمور الدنيوية والجبلية التى لا دخل لها بالأمور الدينية، ولاصلة لها بالوحى.

ইসলামী পরিভাষায় সুন্নাহ:

এ উম্মাতের জন্য শরীয়তের উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে যে সব কথা, কাজ ও সম্মতি প্রকাশ পেয়েছে তাকেই সুন্নাহ سنة বলা হয়। অতএব দ্বীনি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এবং ওয়াহীর সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন সব পার্থিব ও সৃষ্টিগত বিষয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রকাশ হলেও তাহা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আশা করা যায় এ সংজ্ঞাটিই যুক্তিযুক্ত ও মতভেদ মুক্ত সঠিক সংজ্ঞা। والله تعالى أعلم

সুন্নাহর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের মধ্যে সম্পর্ক:

সূন্নাহের পারিভাষিক ও আভিধানিক উভয় অর্থের মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে দেখা যায় সুন্নাহের আভিধানিক অর্থটি ব্যাপক। সুন্নাহর আভিধানিক অর্থ হল, পথ ও পদ্ধতি, রীতি ও নীতি। যে কোন মানুষের পথ পদ্ধতি, ও রীতি নীতেকেই সুন্নাত বলা যেতে পারে। কিন্তু পারিভাষিক অর্থ খাস। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওতী জীবনের পদ্ধতি ও রীতি-নীতিকেই পরিভাষায় সুন্নাত বলা  হয়। কুরআনের বিপরীতে সুন্নাতের ব্যবহার করা করা হয়ে থাকে। সুতরাং, একমাত্র খুলাফায়ে রাশেদিনের পথ, পদ্ধতি ও রীতি-নীতি ছাড়া আর কারো পথ পদ্ধতি ও রীতি-নীতিকে সুন্নাত বলা যাবে না। শুধুমাত্র খুলাফায়ে রাশেদিনের পথ, পদ্ধতি ও রীতি-নীতিকে সুন্নাত বলা যাবে। যেমন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-  عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي عضوا عليها بالنواجذ “তোমরা আমার সূন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সূন্নাতকে আঁকড়ে ধর। তার উপর তোমরা অটুট থাক। আবু দাউদ, তিরমিযি ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেন”।[3]
মূলত: মুহাদ্দিসদের নিকট সুন্নাহর সংজ্ঞার ফলাফল এটাই আসে, তাই সুন্নাহ [سنة] এর আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থে কোন ভিন্নতা নেই।
উপরে উল্লেখিত বিষয়ে একটি কথা স্পষ্ট হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কাজ ও সম্মতিকে সুন্নাত বলে। নিম্নে এ বিষয়ের উপর প্রমাণ তুলে ধরা হল।

রাসূলের কথা সুন্নাত হওয়ার প্রমাণ:

ইমাম বুখারি আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেন তিনি বলেন-
أن النبي عليه السلام قال له رجل أوصني ، قال: ” لا تغضب فردد مرارا ، قال: لا تغضب
“এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনি আমাকে নসিহত করুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি রাগ করো না। লোকটি আবারও বলল, আমাকে নসিহত করুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তর দিলেন, তুমি রাগ করো না।[4] এভাবে কয়েকবার সে নসিহত করার কথা বললে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বার বার একই উত্তর দিলেন এবং বললেন, তুমি রাগ করও না।‌‍ অনুরূপভাবে ইমাম মুসলিম আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, তোমাদের কেউ যখন কোন অন্যায় কর্ম সংঘটিত হতে দেখে, সে তাকে হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, যদি সম্ভব না হয়, মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করবে, আর এটি হল ঈমানের সর্ব নিম্ন স্তর”।[5]উল্লেখিত হাদিস-দ্বয়ের প্রথম হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সাহাবীকে একটি নির্দোষ দিলেন, যা পালন করা এবং রাসূলের অনুসরণ করা তার জন্য ওয়াজিব। আর তা হল, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা। আর দ্বিতীয় হাদিসে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা নির্দেশ দিয়েছেন এটিও রাসূলের কথা। তবে তার অনুসরণ করাও ওয়াজিব।

রাসূলের কর্ম সুন্নাত হওয়ার প্রমাণ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কর্ম সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,صلوا كما رأيتموني أصلي  “তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ ঠিক সেভাবে সালাত আদায় কর”।[6] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, لتأخذوا عني مناسككم “তোমরা হজের বিধানগুলো আমার থেকে গ্রহণ কর”।[7] এ দুটি হাদিস প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে সালাত আদায় করেছেন সেভাবে সালাত আদায় করল বা রাসূল যেভাবে হজ পালন করেছে ঠিক সেভাবে হজ পালন করল, সে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ ও অনুকরণ করল। তার আমল শরীয়তের বিধান অনুযায়ী হল। এ ধরনের দৃষ্টান্ত হাদিসে আরও অনেক বিদ্যমান আছে। যেমন চোরের হাত কাটা আল্লাহর কথার-বর্ণনা অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তায়াম্মুম করা যখন তিনি জমিনে দু হাত দিয়ে আঘাত করে তারপর তা দিয়ে চেহারা ও হাত-দ্বয় মাসেহ করেন। আল্লাহর বাণীর বর্ণনা স্বরূপ।

রাসূলের সম্মতি সুন্নাত হওয়ার প্রমাণ:

ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ বিন মুফাজ্জাল রাদিআল্লাহু আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
 أصبت جرابا من شحم يوم خيبر قال: فالتزمته فقلت: لا أعطي اليوم أحدا من هذا شيئا قال: فالتفت فإذا رسول الله – صلى الله عليه وسلم – مبتسما
“খাইবরের যুদ্ধের দিন আমি চর্বির একটি মশক পেলাম এবং আমি সেটিকে আমার নিজের কাছে রেখে বললাম, আমি এ থেকে একটুও কাউকে দেবো না। আমি এ কথা বলে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসছেন”।[8]
হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন এবং কোন প্রতিবাদ করলেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসি এবং প্রতিবাদ না করা দ্বারা প্রমাণিত হয় এটি ছিল এ কর্মের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মতি। এতে আরও প্রমাণিত হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার মতই একটি পরিপূর্ণ শরীয়ত। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দস্তরখানে গুই সাপ খাওয়া। তিনি দেখা সত্ত্বেও কোন প্রকার প্রতিবাদ করেননি, এতে প্রমাণিত হয় তা খাওয়া ছিল হালাল।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্ম কখন উম্মতের জন্য আদর্শ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্ম কয়েক প্রকার:
কিছু কর্ম আছে স্বভাবগত ও অভ্যাগত। যেমন, উঠা, বসা, খাওয়া-দাওয়া, পায়খানা, প্রশ্রাব, ঘুমানো ইত্যাদি। এ ধরনের কর্মগুলো রাসূলের জন্য ও তার  উম্মতের বৈধ কর্ম হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোন প্রকার বিরোধ বা দ্বিমত নাই। এ ধরনের কর্মসমূহের ক্ষেত্রে রাসূলের অনুকরণ করাটা শরিয়তের বিধি-বিধানের আওতাভুক্ত নয়। এটি সুন্নাত, নফল, ওয়াজিব বা ফরজের আওতায় পড়ে না। বরং শুধু এ কথাই প্রমাণ করে, এ ধরনের কর্ম করা বৈধ।  সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথাও দাঁড়াইল, বা নির্ধারিত কোন বাহনে আরোহণ করল বা কখনও সে কোথাও বসল, কোন নির্ধারিত রঙের জামা পরিধান করল এবং নির্ধারিত কোন খাওয়ার গ্রহণ ইত্যাদি তার অনুকরণে সে রঙের জামা পরিধান করতে হবে বা নির্ধারিত জামা পরিধান করতে হবে এবং নির্ধারিত স্থানে বসতে এমন কোন কথা শরিয়ত সম্মত নয় এবং যে ব্যক্তি এ ধরনের ক্ষেত্রে রাসূলের অনুকরণ করল না তাকে এ কথা বলা যাবে না যে লোকটি রাসূলের সূন্নাত তরককারি। তবে যদি এ সব স্বভাবগত বা অভ্যাগত কর্ম বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পক্ষ হতে আলাদা কোন দলীল পাওয়া যায় তবে তার বিধান অবশ্যই ভিন্ন হবে। যেমন, বাম হাত দিয়ে না খেয়ে ডান হাত দিয়ে খাওয়া। এটি সুন্নাত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ডান দিয়ে খেতেন এবং ডান হাত খাওয়ার নির্দেশ দেন। অন্যথায় এ ধরনের রাসূলের অনুকরণের কোন প্রয়োজন নাই। কারণ, ওমর রাদিআল্লাহু আনহু হতে প্রমাণিত:
أنه كان في سفر فرأى قوما ينتابون مكانا يصلون فيه فقالما هذا؟ قالوا: هذا مكان صلى فيه رسول الله – صلى الله عليه وسلم – فقالومكان صلى فيه رسول الله – صلى الله عليه وسلم -؟ أتريدون أن تتخذوا آثار أنبيائكم مساجد؟ إنما هلك من كان قبلكم بهذا ، من أدركته الصلاة فيه فليصل وإلا فليمض
অর্থ, ওমর রাদিআল্লাহু আনহু একটি সফরে দেখতে পেলেন একদল লোক একটি স্থানে পালাক্রমে সালাত আদায় করতে ছিল, তা দেখে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কি দেখছি? তারা বলল, এ জায়গাটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করেন। তখন তিনি বললেন, সত্যি কি এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করেছেন? আর তোমরা কি চাও নবীদের নিশানা গুলোকে সেজদার স্থান বানাতে? তোমাদের পূর্বের উম্মতরা এ জন্য ধ্বংস হয়েছে-তারা তাদের নবীদের নিশানাগুলোকে সেজদা করার স্থান বানাত। তোমাদের কারো চলার পথে যদি সালাতের সময় হয়ে যায় সে এখানে সালাত আদায় করবে, অন্যথায় সে চলে যাবে। অর্থাৎ, এখানে সালাত আদায় করার আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নাই। যার জন্য এখানে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে একত্র হতে হবে। তবে এ সালাত আদায় করা যে অবৈধ তাও বলা যাবে না। কারণ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের জন্য পুরো যমীনকে মসজিদ ও পবিত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং, সব জায়গায় সালাত আদায় করা যাবে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে সালাত আদায় করেছেন সেখানে সালাত আদায় করতে হবে এমন কোন কিছু করা হতে বিরত থাকতে হবে।
আর যে সব কর্ম রাসূলের সাথে খাস বা রাসূলের বৈশিষ্ট্য বলে প্রমাণিত ঐ কর্মের ক্ষেত্রে রাসূলের সাথে কেউ অংশীদার হতে পারবে না। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর চাশতের সালাম, বিতরের সালাত, তাহাজ্জুদের সালাত ফরজ ছিল। কিন্তু উম্মতের জন্য এগুলো ফরজ নয়। ফলে কেউ এ ইবাদাতগুলিকে আদায় করার ক্ষেত্রে ফরজ হিসেবে নিজের উপর চাপিয়ে দেয়া বা বাধ্যতামূলক করে নেয়ার কোন সুযোগ নাই। অনুরূপভাবে চারের অধিক বিবাহ করা এবং লাগাতার রোজা রাখা ইত্যাদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। উম্মতের কারো জন্য এ ক্ষেত্রে রাসূলের অনুকরণ করার কোন সুযোগ নাই।
যদি রাসূলের কর্মের উপর আমাদের জন্য তার মৌখিক বর্ণনা জানা যায়, তাহলে এ ধরনের কর্মের উপর অবশ্যই শরীয়তের বিধান বর্তায় এবং উম্মতের জন্য তার অনুকরণ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের কর্ম সম্পাদন করার পর বলেন, صلوا كما رأيتموني أصلي“তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে সালাত আদায় কর”।[9] হজের বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 لتأخذوا عني مناسككم فإني لا أدري لعلي لا أحج بعد حجتي هذه رواه مسلم
তোমরা আমার থেকে তোমাদের হজের কর্মসমূহ শিখে নাও। কারণ, হতে পারে আমি আমার এ হজের পর আর হজ নাও করতে পারি।[10]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কতক কর্ম আছে যেগুলো স্বভাবজাতও নয় এবং তার জন্য খাসও নয় এবং কুরআনের ব্যাখ্যাও নয়, এ ধরনের কর্ম সম্পর্কে অবশ্যই ব্যাখ্যার প্রয়োজন এবং এ ধরনের কর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে।

এক- যদি এমন কোন আলামত পাওয়া যায় যদ্বারা প্রমাণিত হয়, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর বা তার জন্য বিধান-ওয়াজিব, মোস্তাহাব বা মু-বাহ ইত্যাদি-। তাহলে এ ক্ষেত্রে উম্মতের বিষয় ও তার বিষয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যদি কোন কিছু পালন করা ওয়াজিব হয়ে থাকে তা উম্মতের জন্যও পালন করা ওয়াজিব অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য যদি কোন কিছু মোস্তাহাব হয়ে থাকে, তা উম্মতের জন্যও পালন করা মোস্তাহাব; এ ক্ষেত্রে উম্মত ও রাসূল উভয়েই সমান; কোন প্রকার তারতম্য করার সুযোগ নাই। কারণ, শরিয়তের মূলনীতি হল, যারা শরিয়তের বিধানের মুকাল্লাফ তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না।

 

দুই- যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন আমল বা কর্ম করে থাকেন, আর সে যে কর্মটি করেছেন, তা কি ওয়াজিব হিসেবে, নাকি মোস্তাহাব বা বৈধ হিসেবে করেছেন, তার উপর কোন প্রমাণ না থাকে, তাহলে এ সব কর্মের ক্ষেত্রে বিধান হল, হয়তো এ সব কর্মগুলোর অনুকরণ করা দ্বারা একজন ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হবে। যেমন, ‘দুই রাকাত সালাত’ যেটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় করেননি মাঝে মধ্যে করেছেন। কেউ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুকরণে পালন করে, সাওয়াব পাবে, এবং এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুকরণ করা মোস্তাহাব বলে গণ্য হবে।

অথবা তাতে সাওয়াবের কোন উদ্দেশ্য না থাকে, যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় চুল লম্বা করা, পাগড়ী পরিধান করা ও পাগড়ীর দুই মাথাকে দুই কাদের উপর ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি। এতে আলেমদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে।

 

এক- কেউ কেউ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ধরনের কর্মগুলো মোস্তাহাব। তাদের যুক্তি হল, রাসূল নিজেই হলেন শরিয়তের প্রণেতা। সুতরাং, তার কর্মই হল শরিয়ত।

 

দুই- আর কেউ কেউ বলেন, এ ধরনের কর্ম মুবাহ এবং এগুলো তার স্ব-ভাবজনিত কর্ম ইবাদত নয়। সুতরাং, যদি কোন ব্যক্তি তার মাথার চুল কাটে বা ছাটে এবং যদি কেউ পাগড়ী পরিধান না করে, তাকে এ কথা বলা যাবে না, লোকটি সূন্নাত তরককারি।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ইসলামী শরীয়তে সুন্নাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলাম কোন মানব রচিত জীবন ব্যবস্থা নয় বরং এটি একটি ওহী ভিত্তিক আল্লাহ প্রদত্ত ও মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। ইসলামী শরীয়তের মূলনীতি হল কুরআন ও সুন্নাহ। পবিত্র কুরআন যেমন ওহী প্রদত্ত, সুন্নাহও তেমনি ওহী প্রদত্ত। শরীয়তের এ দুটি মূলনীতি একটির সাথে অপরটি আঙ্গাঙ্গিন ভাবে জড়িত। এ দুটির কোন একটিকে বাদ দিয়ে শরীয়তের কথা চিন্তা করার কোন অবকাশ নাই। কুরআন হল, আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ ওহী, আর হাদিস তারই ব্যাখ্যা। কুরআনের কোন বিধানের উপর আমল করতে হলে হাদিস অবশ্যই জরুরি। হাদিস ছাড়া কুরআন অনুযায়ী আমল করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়।

 

এক- আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে হাদিস বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  دعوني ما تركتكم إنما أهلك[11] من كان قبلكم لكثرة سؤالهم واختلافهم على أنبيائهم فإذا نهيتكم عن شيء فاجتنبوه وإذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم متفق عليه  “আমি তোমাদের যে অবস্থায় রেখে যাই তার উপর তোমরা অটুট থাক। তোমাদের পূর্বের উম্মতরা অধিক প্রশ্ন করা এবং নবীদের সাথে বিরোধ করার কারণেই ধ্বংস হয়েছে। আমি যখন তোমাদের কোন বিষয়ে নিষেধ করি, তোমরা তা হতে বিরত থাক। আর যখন তোমাদের কোন বিষয়ে নির্দেশ দেই তা যথা সম্ভব পালন করতে চেষ্টা কর”।[12]

 

দুই-এরবায ইবনে সারিয়া রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذ رواه أبو داود والترمذي وقال حديث حسن صحيح
  “তোমরা আমার সূন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সূন্নাতকে আঁকড়ে ধর। তার উপর তোমরা অটুট থাক। আবু দাউদ, তিরমিযি ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেন”।[13]

 

তিন- আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى ، قيل: ومن يأبى يا رسول الله؟ قال: من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني فقد أبى رواه البخاري
“যে ব্যক্তি অস্বীকার করে, সেই ব্যক্তি ব্যতীত আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে; সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি অস্বীকার করে? তখন তিনি বললেন: যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্য, সে ব্যক্তিই অস্বীকার করে।”[14] সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হয় এবং তাঁর সুন্নাহ’র বিরুদ্ধাচরণ করে, সে ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে; আর আবদ্ধ হয় জাহান্নামের প্রচণ্ড হুমকির জালে।

 

চার- আবু রাফে রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لا ألفين أحدكم متكئا على أريكة يأتيه الأمر من أمري مما أمرت به أو نهيت عنه فيقول لا أدري: ما وجدناه في كتاب الله اتبعناهحديث صحيح رواه الشافعي ،
“তোমাদের কাউকে কাউকে দেখা যাবে, সে হেলান দিয়ে বসে আছে, কিন্তু তার নিকট যখন আমার কোন আদেশ- যে বিষয়ে আমি আদেশ দিয়েছি বা কোন নিষেধ- যে বিষয়ে আমি নিষেধ করেছি তা পৌঁছবে তখন সে বলবে, এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আমরা আল্লাহর কিতাবে যা পেয়েছি তাই মানবো”।
ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশের অনুসরণ করা মানুষের উপর ফরয প্রমাণ করে রাসূলের সূন্নাত আল্লাহর পক্ষ থেকেই গৃহীত। যে ব্যক্তি রাসূলের সূন্নাতের অনুসরণ করল, সে আল্লাহর কিতাবেরই অনুসরণ করল। কারণ, আমরা এমন কোন প্রমাণ পাই নাই যাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের শুধু আল্লাহর কিতাবের অনুসরণের জন্য বাধ্য করেছেন। বরং সব জায়গায় আল্লাহ তা’আলা প্রথমে তার কিতাব তারপর তার নবীর সূন্নাতের অনুসরণের কথা বলেছেন।
পবিত্র কুরআনে সুন্নাতের গুরুত্ব
১- আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم : ٣،  ٤]
“আর তিনি [নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না বরং শুধুমাত্র তাকে যা ওহী করা হয় তাই বলেন”।[15]
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীনী কথা, কাজ ও সম্মতি সব কিছুই ওহী ভিত্তিক। এ জন্যই আল্লাহর নির্দেশকে যেমন কোন ঈমানদার নর-নারীর উপেক্ষা করে চলার সুযোগ নেই। তেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশেরও কোন অবস্থাতেই উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নাই।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦ ﴾ [الاحزاب : ٣٦]
“আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের নির্দেশ দিলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে কোন এখতিয়ার থাকে না, আর যে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হয় সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টটায় পতিত হয়”।[16]
এ আয়াত ইসলামী শরীয়তে সুন্নাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, আল্লাহ বা কুরআনের নির্দেশের অবস্থান এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবা সুন্নাহর নির্দেশের অবস্থান পাশাপাশি। অনুরূপভাবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে যেমন পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ অমান্যের পরিণতিও একই; কোন অংশে তা কম নয়। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সিদ্ধান্ত ও সমাধানকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাথা পেতে মেনে নেয়া ছাড়া ঈমানদার হওয়া কখনই সম্ভব নয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]
“অতঃপর তোমার রবের কসম তারা কখনও ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ফায়সালা কারী হিসাবে মেনে নেয়, অতঃপর তোমার ফায়সালার ব্যাপারে তারা তাদের অন্তরে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে”।[17]
সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া যেমন ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়, ঈমানদার হওয়ার পর তেমনি আবার সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া পূর্ণ ইসলাম মানাও সম্ভব নয়। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হাসান বাসরী [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা সাহাবী ঈমারান বিন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু কিছু ব্যক্তিসহ শিক্ষার আসরে বসেছিলেন। তাদের মধ্য হতে একজন বলে ফেললেন, আপনি আমাদেরকে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু শোনাবেন না। তিনি [সাহাবী] বললেন: নিকটে আস, অতঃপর বললেন, তুমি কি মনে কর, যদি তোমাদেরকে শুধু কুরআনের উপরই ছেড়ে দেয়া হয়? তুমি কি যোহরের সালাত চার রাকাত, আসর চার রাকাত, মাগরিব তিন রাকাত, প্রথম দুই রাকাতে কিরাত পাঠ করতে হয় ইত্যাদি সব কুরআনে খুঁজে পাবে? অনুরূপভাবে কাবার তাওয়াফ সাত চক্কর এবং সাফা-মারওয়ার তাওয়াফ ইত্যাদি কি কুরআনে খুঁজে পাবে? অতঃপর বললেন: হে মানব সকল! তোমরা আমাদের [সাহাবীদের] নিকট হতে সুন্নাহর আলোকে ঐ সব বিস্তারিত বিধি-বিধান জেনে নাও। আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা যদি সুন্নাহ্ মেনে না চল, তাহলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।
শুধু কুরআনুল করীমকে আঁকড়িয়ে ধরে পূর্ণ ইসলাম মানা কখনও সম্ভব নয় বরং এ নীতি মানুষকে পথভ্রষ্ট করে ইসলাম হতে বের করে দিবে এবং পরকালে জান্নাত পাওয়াও অসম্ভব হয়ে যাবে। সুতরাং পরকালে জান্নাত পেতে হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিয়ে আসা আল্লাহর বাণী আল-কুরআনুল করীম এবং তাঁর হাদিস বা সুন্নাহ্ উভয়েরই একনিষ্ঠ অনুসারী হতে হবে। হাদিসে এসেছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ كُلُّ أُمَّتِي يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِي دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ عَصَانِي فَقَدْ أَبَى
সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে তবে যারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে তারা ব্যতীত। জিজ্ঞাসা করা হল, কারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে? তিনি বললেন: যে আমার অনুসরণ করে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমাকে অমান্য করে সেই অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে।[18]
এ হাদিস স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্ অনুসরণের কোন বিকল্প পথ নেই।
অতএব ইসলামী শরীয়তে সুন্নাহর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটুকু তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। ইহা ছাড়াও সুন্নাহর গুরুত্ব সম্পর্কে আরও কতগুলি বিষয় তৃতীয় পরিচ্ছেদে তুলে ধরা হল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের অকাট্য দলীল কুরআন ও হাদিসের আলোকে:

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান, আর এ ইসলামের বিধানগুলি যেমনি ভাবে আল কুরআনের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয় তেমনি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর মাধ্যমেও সাব্যস্ত হয়, সুতরাং সুন্নাহ্ ইসলামের অকাট্য দলীল, বিষয়টি কুরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মার ইজমার আলোকে নিম্নে আলোকপাত করা হল।

আল কুরআনের আলোকে:

মহান আল্লাহ তা’আলার বাণী ইসলামের প্রথম মূলনীতি আল কুরআনের অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ আনুগত্য ছাড়া ঈমান ও ইসলাম মানা সম্ভব নয়, এ প্রসঙ্গে নিম্নে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হল:

[ক] সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ছাড়া ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়:
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١ ﴾ [الانفال: ١]  “তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর”।[19]
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের আনুগত্য করার কথাই বলা হয়েছে। সুতরাং,কোন ঈমানদারের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে এড়িয়ে চলার কোন সুযোগ নেই।

[খ] সুন্নাতে রাসূল বর্জন করা কুফরী কাজ:

আল্লাহ তা’আলা বলেন,
 ﴿قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَۖ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٢﴾ [ال عمران: ٣٢]
“বলুন আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, আর যদি তারা পলায়ন করে, তাহলে আল্লাহ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না”।[20]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য হতে পলায়ন করা অর্থাৎ তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ বর্জন করা, ইহা প্রকাশ্য কুফরী।

[গ] করণীয় ও বর্জনীয় ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই একমাত্র মাপকাঠি:

 আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧ ﴾ [الحشر: ٧]   “রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক, আর আল্লাহকে ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তি দাতা”।[21]
এ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দেয়া অর্থ হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের যে সব বিধি-বিধান দিয়েছেন, অর্থাৎ কুরআন এবং হাদিস, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, إنِّىْ أُوْتِيْتُ الكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَه “আমাকে কিতাব [কুরআন] এবং উহার অনুরূপ [সুন্নাহ্] দেয়া হয়েছে।” আর এটাই তিনি তাঁর উম্মতকে দিয়েছেন।[22]

[ঘ] কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমেই কেবল মাত্র দ্বন্দ্বের সমাধান হতে হবে:

 আল্লাহ তা’আলা বলেন,
 ﴿ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [النساء : ٥٩]
“যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণ কর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম”।[23]
ইমাম তাবারী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন: আয়াতের অর্থ হল যখন তোমাদের মাঝে কোন ধর্মীয় বিষয়ে বিবাদ পরিলক্ষিত হবে, তখন তার সমাধান ও ফয়সালা হল একমাত্র আল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব কুরআন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর আদেশ ও নিষেধের মাধ্যমে এবং তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুন্নাতের মাধ্যমে।
এ আয়াতের শিক্ষা হল আমরা যদি সত্যিকার আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমানদার হই তাহলে আমাদের মাঝে ধর্মীয় বিবাদের সমাধান কোন ইমাম, পীর,দরবেশ, মত ও পথের মাধ্যমে না হয়ে হতে হবে একমাত্র আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ সুন্নাহর মাধ্যমে।

[ঙ] আল্লাহকে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হল সুন্নাহর অনুসরণ:

আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١﴾ [ال عمران: ٣١]   “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দিবেন, আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু”।[24]
এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আয়াত যা বিদ্বানদের নিকট آية الإمتحان বা পরীক্ষার আয়াত বলে পরিচিত। ইমাম আব্দুর রহমান মুবারকপরী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, এ আয়াত হতে সাব্যস্ত হয় যে, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস অনুসরণ করে না এবং সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব মনে করে না, সে আল্লাহকে ভালবাসার মিথ্যুক দাবীদার। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসায় মিথ্যুক প্রমাণিত হয়, সে মূলত: আল্লাহর প্রতি ঈমানের মিথ্যুক দাবীদার। অতএব সত্যিকার ঈমানদার ও আল্লাহর প্রিয় হতে হলে সকল গাউছ-কুতুব, পীর-দরবেশ ও ওলী-আওলীয়াকে বাদ দিয়ে একমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসারী হতে হবে।

[চ] সুন্নাহর বিরোধিতা হলে ফিতনা ও যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সম্মুখীন হতে হবে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور : ٦٣]
“সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন সতর্ক হয় যে, তাদেরকে ফিতনা পেয়ে যাবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে”।[25]অতএব ইহকাল ও পরকালে ফিতনা ও শাস্তি হতে রক্ষা পেতে হলে সুন্নাহ অনুসরণের বিকল্প কোন পথ নেই।

[ছ] মুসলিম উম্মার উত্তম আদর্শের প্রতীক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম:

আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ لِّمَن كَانَ يَرۡجُواْ ٱللَّهَ وَٱلۡيَوۡمَ ٱلۡأٓخِرَ وَذَكَرَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا ٢١﴾ [الاحزاب : ٢١]
“তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝেই রয়েছে উত্তম আদর্শ, এটা তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে”।[26]
ইমাম ইবনে কাছীর [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের বিষয়ে এ আয়াতটি একটি অকাট্য ও বড় ধরণের প্রমাণ —-।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ইসলামী নীতিমালার এক অবিচ্ছেদ অংশ, যা ছাড়া ইসলাম কখনও পূর্ণতা লাভ করতে পারে না, সুন্নাহ ইসলামের এক অকাট্য দলীল এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে, নমুনা স্বরূপ সামান্য কিছু উপস্থাপন করা হল, এখন আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের আলোকে বিষয়টি জানার চেষ্টা করি।

হাদিসের আলোকে:

সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল কুরআনের আলোকে প্রমাণিত হওয়ার পর এ বিষয়ে হাদিসের অবতারণার প্রয়োজন হয় না বরং ইসলামের কোন বিধান প্রমাণের জন্য একটি বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট দলীলই যথেষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু পাঠক সমাজের কাছে বিষয়টি আরও স্পষ্ট ও আলোকিত হওয়ার জন্য “সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীলের” প্রমাণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নিম্নে উপস্থাপন করা হল:

[ক] প্রসিদ্ধ সাহাবী জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু সংখ্যক ফিরিস্তা আসলেন, তাদের কেউ বললেন, তিনি ঘুমন্ত, আবার কেউ বললেন: তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত কিন্তু অন্তর জাগ্রত। অতঃপর তারা বললেন, তাঁর একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে তোমরা সে দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর, অতঃপর বললেন, তাঁর দৃষ্টান্ত হল ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সুসজ্জিত করে একটি গৃহ নির্মাণ করল, অতঃপর সেখানে খাওয়ার আয়োজন করল এবং একজন আমন্ত্রণকারী প্রেরণ করল, অতঃপর যে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল, গৃহে প্রবেশ করল এবং আয়োজিত খানা খেল। আর যে আমন্ত্রণ গ্রহণ করল না, গৃহেও প্রবেশ করল না এবং আয়োজিত খানাও খেল না। এ দৃষ্টান্ত বর্ণনার পর তারা বললেন: দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা করে দিন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝতে পারবেন,কারণ চক্ষু ঘুমন্ত হলেও অন্তর জাগ্রত, তখন তারা ব্যাখ্যায় বললেন,
فَالدَّارُ الْجَنَّةُ وَالدَّاعِي مُحَمَّدٌ فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا  فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَمُحَمَّدٌ  فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ
“নির্মিত গৃহটি হল জান্নাত, আর আমন্ত্রণকারী হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অতএব যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য স্বীকার করে, সে যেন প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা’আলরই আনুগত্য স্বীকার করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অমান্য করল, সে যেন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’আলাকেই অমান্য করল। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মানুষের মাঝে [ন্যায় ও অন্যায়ের] পার্থক্যকারী”।[27]

[খ] সাহাবী আল ঈরবায বিন সারিয়াহ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন:

صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَأَوْصِنَا فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ  الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّنَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ [أحمد، أبو داود، الترمذى وإبن ماجة] قال الترمذى حديث حسن صحيح.
“একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের একদিন সালাত পড়ালেন, অতঃপর সালাত শেষে আমাদের দিকে মুখ করে বসে হৃদয় স্পর্শী বক্তব্য শোনালেন, বক্তব্য শুনে আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং হৃদয়ে কম্পন শুরু হল, আমরা আবেদন করলাম হে রাসূলুল্লাহ! মনে হয় ইহা যেন বিদায়ী ভাষণ,অতএব আমাদেরকে কিছু উপদেশ দিন! তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার উপদেশ হল তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের [ধর্মীয় নেতার] আনুগত্য স্বীকার কর এবং তার কথা শ্রবণ কর, যদিও হাব্শী কৃতদাস তোমাদের নেতা হয়ে থাকে। জেনে রেখ তোমাদের মধ্য হতে আমার পরে যে বেঁচে থাকবে সে [দ্বীনী বিষয়ে] বহু মতভেদ দেখতে পাবে, এমতাবস্থায় তোমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হল আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর এবং সুপথ প্রাপ্ত আমার [চার] খোলাফায়ে রাশিদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধর। আর সাবধান থাক [দ্বীনের নামে] নব আবিষ্কৃত বিষয়সমূহ হতে! কারণ প্রতিটি [দ্বীনের নামে] নব আবিষ্কৃত বিষয় হল বিদ’আত, আর সকল প্রকার বিদ’আত হল পথভ্রষ্টটা।[28]
এ মূল্যবান হাদিসটি হতে আমরা একাধিক বিষয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, প্রথমত: ইহা প্রমাণ করে যে, সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল, তাই তাহা আঁকড়ে ধরতেই হবে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত: সুন্নাহ এর বিপরীত বিষয় হল বিদ’আত, বিদ’আতের পরিচয় হল: ইসলামে ইবাদাতের নামে এমন কোন নতুন বিষয়, অথবা মূল বিষয়ের কোন সংযোজন চালু করা যা কুরআন ও সুন্নায় প্রমাণিত নয়। এরূপ সকল বিদ’আতই ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য, কারণ আলোচ্য হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ “সকল প্রকার বিদ’আত পথভ্রষ্টটা” অন্য বর্ণনায় এসছে كُلَّ بِدْعَةٍ ضََلالَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّار “সকল প্রকার বিদ’আতই পথভ্রষ্টটা, আর সকল পথভ্রষ্টটার পরিণতি হল জাহান্নাম।” অতএব মনের খেয়াল খুশী অনুযায়ী বিদ’আতকে ভাগাভাগি করার কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে পূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরে এবং সকল প্রকার বিদ’আত বর্জন করে সঠিক ইসলাম মেনে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন!

[গ] সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

تَرَكْتُ فِيْكُمْ شَيْئَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا بَعْدَ هُمَا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّتِيْ
“তোমাদের মাঝে দু’টি বিষয় রেখে গেলাম যতক্ষণ সে দু’টি আঁকড়ে ধরে থাকবে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, আল্লাহ তা’আলার কিতাব ও আমার সুন্নাত”।
এ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জে লক্ষাধিক জনতার সামনে জীবনের শেষ হজ্জে শেষ ভাষণে শেষ উপদেশ প্রদান কালে বলেন: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর সুন্নাতই হল সুপথ ও বিপথের মাপকাঠি, এ দু’টিকে সমানভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। শুধু কুরআনকে আঁকড়ে ধরে যেমন সুপথ হতে পারে না, তেমনি শুধু সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরেও সুপথ হতে পারে না। তাই কুরআন ও সুন্নাহ উভয়কে সমানভাবে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে কেবল মানুষ তার দ্বীনকে সংরক্ষণ করতে পারবে, নচেৎ কখনও সম্ভব নয়।
সুন্নাহ ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল প্রমাণ করার জন্য নমুনা স্বরূপ এ তিনটি হাদিস উপস্থাপন করেই শেষ করতে চাই, মূলত: এ বিষয়ে অসংখ্য সহীহ হাদিস রয়েছে যা তুলে ধরলে ছোটখাটো একখানা পুস্তক হয়ে যাবে।

ইজমার আলোকে:

সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল, যা পবিত্র কুরআনের আলোকে অতঃপর হাদিসের আলোকে আলোচনা করা হল। উক্ত আলোচনা হতে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, কোন ঈমানের দাবিদার সুন্নার অনুসরণ হতে দূরে থাকতে পারে না এবং কুরআন ও সুন্নাহর ঊর্ধ্বে কোন কিছুকে প্রাধান্য দিতে পারে না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
 ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ١ ﴾ [الحجرات: ١]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের অগ্রে কোন কিছু প্রাধান্য দিও না, আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুননে ও জানেন[29]।”অতএব, কোন ঈমানদার আল্লাহভীরু জ্ঞানীব্যক্তি সুন্নাহবিরোধী হতে পারে না। ইমাম শাফেয়ী [রাহিমাহুল্লাহ] স্বীয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কিতাবুল উম্মে বলেন:
]لم أسمع أحدا نسبه الناس أو نسب نفسه إلى علم، يخالف في أن فرض الله عزوجل اتباع أمر رسول الله والتسليم لحكمه بأن الله عزوجل لم يجعل لأحد بعده إلا اتباعه[
অর্থাৎ “আল্লাহ তা’আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ অনুসরণ করা এবং তাঁর ফায়সালা মাথা পেতে মেনে নেয়া যে ফরয করে দিয়েছেন এ বিষয়ে কোন জ্ঞানী ব্যক্তিকে দ্বিমত পোষণ করতে আমি শুনিনি। কারণ আল্লাহ তা’আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরবর্তী কোন ব্যক্তির জন্য তাঁর অনুসরণের বিকল্প পথ রাখেননি।” অতএব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ইসলামের অকাট্য দলীল ও অনুসরণীয় হওয়াতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
 চতুর্থ পরিচ্ছেদ
 আল-কুরআনের সাথে সুন্নাহর সম্পর্ক
কুরআনুল করীম আল্লাহ তা’আলার বাণী যা সরাসরি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে জিবরীলের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ওহী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। অপর পক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ আল্লাহ তা’আলার বাণী না হলেও তা ওহী হতে মুক্ত নয়, বরং তাও ওহী এর অন্তর্ভুক্ত,আল্লাহ তা’আলাই সে স্বীকৃতি দিয়েছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন: ﴿وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤﴾ [النجم : ٣،  ٤]   “আর তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না বরং যা ওয়াহী করা হয় তাই বলেন[30]।”
অতএব আল কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে তেমন কোন দূরত্ব নেই বরং ওয়াহীর সূত্রে এক অপরের সাথে সম্পৃক্ত ও পরিপূরক। তাইতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:إِنِّيْ أُوْتِيْتُ الكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ “আমাকে কিতাব [কুরআন] এবং এর সাথে অনুরূপ [সুন্নাহ] দেয়া হয়েছে”।[31] সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর সম্পর্ক হল অতি গভীর। এ বিষয়টি আলোকপাত করতে গিয়ে ইসলামী গবেষকগণ সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন যে, কুরআনের সাথে সুন্নাহর সম্পর্কের তিনটি অবস্থা রয়েছে।
প্রথম অবস্থা: কুরআন ও সুন্নাহর হুবহু মিল থাকবে। যেমন- হাদিসে এসেছে,
عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بُنِيَ الإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ وَحَجِّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيْلاً
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইসলামের ভিত্তি হল পাঁচটি- [১] সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা’বুদ বা উপাস্য নেই এবং সাক্ষ্য প্রদান করা যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’আলার রাসূল। [২] সালাত কায়েম করা, [৩] যাকাত আদায় করা, [৪] রমযান মাসে সাওম পালন করা এবং [৫] সামর্থ্য বান ব্যক্তির বাইতুল্লায় হজ্জ সম্পদান করা।[32]
হাদিসের আলোচ্য বিষয়গুলি হুবহু কুরআনুল করীমেও এসেছে: আল্লাহ তা’আলা বলেন:
 ﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ ١١٠ ﴾ [البقرة: ١١٠]
  “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর”।[33] তিনি আরও বলেন: ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ ١٨٣﴾ [البقرة: ١٨٣]   “হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর [রমাযান মাসের] রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল”।[34] তিনি আরও বলেন, ﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧﴾ [ال عمران: ٩٧]   “আল্লাহর উদ্দেশ্যে [কাবা] গৃহে হজ সম্পাদন করা সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের অপরিহার্য কর্তব্য”।[35]
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমার রাদিআল্লাহু আনহু-এর বর্ণিত হাদিসে যেমন, সালাত, যাকাত, সাওম ও হজ্জ মৌলিকভাবে আলোচিত হয়েছে ঠিক তেমনি কুরআনুল করীমের আয়াতসমূহে উক্ত বিষয়গুলি মৌলিকভাবে আলোচিত হয়েছে। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর মাঝে এ ক্ষেত্রে হুবহু মিল রয়েছে। পার্থক্য শুধু এটাই কুরআনে বিষয়টি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করা হয়েছে আর হাদিসে আরও বিস্তারিত করে আলোচনা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অবস্থা: দ্বিতীয় অবস্থা হল সুন্নাহ কুরআনের মুতলাক [সাধারণ] হুকুমকে মুকাইয়াদ [সীমাবদ্ধ] হিসেবে, মুজমাল [সংক্ষিপ্ত] হুকুমকে মুফাস্সাল [বিস্তারিত] হিসেবে এবং ‘আম [ব্যাপক] হুকুমকে খাস [নির্দিষ্ট] হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। যেমন- সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ, পারস্পারিক আদান-প্রদান ও বেচা-কেনা ইত্যাদি বিষয়গুলি সংক্ষিপ্তভাবে কুরআনে এসেছে, কিন্তু তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসে বিস্তারিত আকারে আলোচিত হয়েছে। মূলত: অধিকাংশ হাদীসই হল কুরআনের সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলি বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্র। পাঠকের কাছে এ বিষয়টি আরও পরিস্কার হওয়ার জন্য নিম্নে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হল।

[১] কুরআনের মুজমাল [সংক্ষিপ্ত] বিষয়গুলি সুন্নাহ মুফসসাল [বিস্তারিত] ভাবে বর্ণনা দিয়েছে।
ইমাম মারওয়াযী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, ইসলামের ফরয মূলনীতিগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়া তা জানা ও আমল করা কখনও সম্ভব নয়, যেমন- সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ ও জিহাদ ইত্যাদি।
[ক] পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ  “তোমরা সালাত কায়েম কর”।[36]
এখানে শুধুমাত্র মুজমাল [সংক্ষিপ্ত]ভাবে সালাত কায়েমের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বর্ণনা করা হয়নি তার নির্দিষ্ট সময়গুলি, নির্দিষ্ট রাকাতের সংখ্যাগুলি ও আরও অন্যান্য বিষয়গুলি। কিন্তু তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদিসে। ফরয সালাতের সময় কখন, যোহরের সময় কখন, আসর,মাগরিব ও এশার সময় কখন? কোন সালাত কত রাকাত, সুন্নাত ও ফরয কত রাকাত? জুমার সালাত কি নিয়মে, ঈদের সালাত কি নিয়মে, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত কি নিয়মে? সুন্নাত সালাত কি নিয়মে? রুকু, সিজদা ও তাশাহহুদ কি নিয়মে এবং কখন কোন কিরাত ও দু’আ পাঠ করতে হবে ইত্যাদি সব বিষয়গুলি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাহর মধ্যে, এমনকি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে তাহা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি বলেন, صلوا كما رأيتموني أصلي “তোমরা ঠিক সেই নিয়ম পদ্ধতিতে সালাত সম্পাদন কর, যেভাবে আমাকে সম্পাদন করতে দেখেছ।”

[খ] আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ  “তোমরা যাকাত আদায় কর”।[37]

এখানে শুধু যাকাত আদায় এর বিধান মুজমাল [সংক্ষিপ্ত]ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু কোন কোন সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে? কোন সময়ে ও কোন নিয়মে তা বিস্তারিত কোন বর্ণনা কুরআনুল করীমে আসেনি, বরং এ সমস্ত মুজমাল [সংক্ষিপ্ত] বিধান মুফাসসাল [বিস্তারিত]ভাবে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসে। কোন কোন সম্পদের যাকাত দিতে হবে এবং কি পরিমাণ সম্পদে, কোন সময় ও নিয়মে যাকাত দিতে হবে সবই সবিস্তারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নায় বর্ণনা করে দিয়েছেন। যেমন- তিনি বলেন:
لَيْسَ فِيْ أَقَلِّ مِنْ خَمْسِ أَوَاقٍ مِن الْوَرَقِ صَدَقَةٌ، وَلاَ فِيْ أَقَلِّ مِنْ خِمْسَةَ أَوْسَقِ صَدَقَةٌ، وَلاَ فِيْ أَقَلِّ مِنْ خَمْسِ ذُوْدٍ صَدَقَةٌ، وَلاَ فِيْ أَقَلِّ مِنْ أَرْبَعِيْنَ مِنَ الْغَنَمِ صَدَقَةٌ، وَلاَ فِيْ أَقَلِّ مِن ثَلاَثِيْنَ مِن الْبَقَرِ صَدَقَةٌ.
“পাঁচ উকিয়া তথা ৫২.১/২ তলার কম রৌপ্য হলে কোন যাকাত নেই, পাঁচ আওসুক তথা প্রায় ১৭ মনের কম ফসল হলে কোন যাকাত নেই, পাঁচটি উটের কম হলে কোন যাকাত নেই, ছাগল ৪০টির কম হলে কোন যাকাত নেই, গুরু ৩০টির কম হলে কোন যাকাত নেই”।[38] ইত্যাদি যাকাতের খুঁটিনাটি সব বিধান বিস্তৃতভাবে সুন্নাহয় বর্ণনা করা হয়েছে।

[গ] আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ “তোমাদের উপর রমাযানের রোযা ফরয করা হয়েছে”।[39]

কিন্তু রমাযান মাস কিভাবে শুরু হবে? সাওম অবস্থায় কি কি নিষিদ্ধ? ফরয সাওমের নিয়ম কি? নফল সাওমের নিয়ম কি? ইত্যাদি বিষয়গুলি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি, পক্ষান্তরে সাওম সম্পর্কীয় যাবতীয় বিধি-বিধান যেমন- চাঁদ দেখেই সাওম শুরু করতে হবে আবার চাঁদ দেখেই সাওম শেষ হবে, এবং কি করলে সাওম সুন্দর হয়, কি করলে নষ্ট হয় ইত্যাদি বিষয়গুলি সবিস্তারে সুন্নায় আলোচনা করা হয়েছে।

[ঘ] আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ ٩٧﴾ [ال عمران: ٩٧] “আল্লাহর উদ্দেশ্যে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কাবা গৃহে হজ সম্পাদন করা অবশ্য কর্তব্য[40]।”

হজের বিধান কুরআন মাজিদে মুজমাল [সংক্ষিপ্ত]ভাবে এসেছে, এর বিস্তারিত বর্ণনা যেমন- কোথা হতে ইহরাম বাঁধবে, কিভাবে ইহরাম বাঁধবে, হজের দিনগুলিতে মক্কায়, মিনায়, আরাফায় কি কি কাজ করতে হবে তা কুরআন মাজিদে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়নি বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নায় সকল ক্ষেত্রের সকল সুন্নাত, ওয়াজিব ও ফরযসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের সকল কর্মক্ষেত্রে সাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন: لتأخُذُوْا عَنِّى مَنَاسِكَكُم “তোমরা আমার নিকট হতে তোমাদের হজের বিধি-বিধান শিখে নাও।”
অতএব এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে প্রতিয়মান হল যে, কুরআন ও সুন্নাহর গভীর সম্পর্ক হল- কুরআন এর বিস্তারিত রূপ দানকারী হচ্ছে সুন্নাহ্। সুন্নাহ্ ব্যতীত কুরআনকে ভালভাবে জানা ও মানা সম্ভব নয়।

[১] কুরআনের মুতলাক [সাধারণ] বিষয়গুলি সুন্নাহ্ মুকাইয়াদ [সীমাবদ্ধ] করে বর্ণনা করেছে।

অর্থাৎ কুরআনুল করীমে কতকগুলি বিধান এমন সাধারণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে কোন রকম সীমা বা নির্ধারিত পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি ফলে কার্যক্ষেত্রে তা পালন করা বা মেনে চলা কঠিন হয়ে যায়, এমন বিষয়গুলি সুন্নাহর মাধ্যমে মুকাইয়াদ বা সীমাবদ্ধ ও নির্ধারিত পরিমাণে করে দেয়া হয়েছে। যার ফলে কার্যক্ষেত্রে তা খুবই সহজসাধ্যে পরিণত হয়েছে।

[ক]  যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,﴿فَٱمۡسَحُواْ بِوُجُوهِكُمۡ وَأَيۡدِيكُم مِّنۡهُۚ ٦﴾ [المائ‍دة: ٦]   “তোমরা তোমাদের চেহারা ও দুই হাত তা [মাটি] দ্বারা মাসাহ কর”।[41]
 কুরআনে তায়াম্মুমের বিধানে দুই হাত মাসাহর বিষয়টি মুতলাক [সাধারণ]ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ কোন সীমা বা নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং এখানে হাত দ্বারা আঙ্গুলের মাথা হতে কাঁধ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অংশকে বুঝাবে। পক্ষান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্ উক্ত অসীম ও অনির্দিষ্ট পরিমাণকে সীমাবদ্ধ [মুকাইয়াদ] করে দিয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে, একদা এক ব্যক্তি ওমার রাদিআল্লাহু আনহু-এর নিকট আসলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, আমার গোসল ফরয হয়ে গেছে কিন্তু আমি পানি পাচ্ছি না এমতাবস্থায় কি করব? তখন আম্মার বিন ইয়াসির রাদিআল্লাহু আনহু ওমারকে রাদিআল্লাহু আনহু বললেন: আপনার কি আমাদের ঐ ঘটনা স্মরণ হচ্ছে না, যখন আপনি এবং আমি এক সাথে সফরে ছিলাম [পানি না পাওয়ায়] আপনি সালাত আদায় করলেন না, আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিলাম অতঃপর [এর মাধ্যমে পবিত্র হয়ে] সালাত আদায় করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফিরে এসে তাঁকে ঘটনা খুলে বললে তিনি বললেন: না তোমরা যেরূপ করেছ তা ঠিক হয়নি বরং এরূপ করাই তোমার জন্য যথেষ্ট ছিল বলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দুই হাত মাটিতে মারলেন, তাতে ফুঁ দিলেন, অতঃপর দুই হাত দিয়ে চেহারা এবং দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত মাসাহ্ করলেন।”
আয়াতে মুতলাকভাবে বর্ণিত হাত মাসাহের বিধানকে সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুকাইয়াদ [সীমিত] করে বর্ণনা দিয়েছে। অর্থাৎ তায়াম্মুমে হাত মাসাহের পরিমাণ হল কব্জি পর্যন্ত যা কুরআনের বর্ণনায় উল্লেখ নেই।

[খ] কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন,﴿وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ فَٱقۡطَعُوٓاْ أَيۡدِيَهُمَا ٣٨﴾ [المائ‍دة: ٣٨] “পুরুষ ও নারী যারা চুরি করে তোমরা তাদের হাত কেটে ফেল[42]।”

কুরআন মাজীদে হাত কাটার বিধানটি মুতলাক [সাধারণ] বা অনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। হাত দ্বারা কোনটি উদ্দেশ্য ডান না বাম? কতটুকু পরিমাণ কব্জি পর্যন্ত, না কনুই পর্যন্ত, না কাঁধ পর্যন্ত? তা সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়নি, বরং সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোরের হাত কাটার বিধানটিকে মুকাইয়্যাদ [সীমাবদ্ধ] ও নির্দিষ্ট করে বর্ণনা দিয়েছে।
সুতরাং কুরআনের মুতলাক বিষয়সমূহ যা পালন করা কঠিন হয়ে যায় সেগুলি সুন্নাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুকাইয়্যাদ [সীমাবদ্ধ]ভাবে বর্ণনা দিয়ে মানুষের জন্য পালনে সহজ সাধ্য করে দিয়েছে।

[২] কুরআনের ‘আম [ব্যাপক] বিধানগুলি সুন্নাহ্ খাস [নির্দিষ্ট] করে বর্ণনা দিয়েছে।

অর্থাৎ কুরআনুল করীমে অনেক বিধি-বিধান ‘আম [ব্যাপক]ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা কার্যক্ষেত্রে পালন করা দুষ্কর হয়ে যায় ঐ সব ‘আম বিধানগুলিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ্ খাস অর্থাৎ আমলের পরিধিকে নির্দিষ্ট করে বর্ণনা দিয়েছে, যা মানুষের জন্য পালনে খুবই সহজসাধ্য হয়ে গেছে। কুরআনের এরূপ বিধানকে মুতাওয়াতির হাদিস দ্বারা খাস বা নির্দিষ্টকরণে সকল আলিম সমাজ একমত। আর খবরে ওয়াহিদ হাদিস দ্বারাও কুরআনের আম হুকুমকে খাস করা যায় এটাই প্রসিদ্ধ চার ইমামের মত বলে উল্লেখ করেছেন ইমাম সাইফুদ্দীন আল আমেদী স্বীয় আল ইহ্কাম গ্রন্থে।

পবিত্র কুরআনের আম [ব্যাপক] হুকুমকে সহীহ সুন্নাহর দ্বারা খাস [নির্দিষ্ট] করার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হল:

[ক] আল্লাহ তা’আলার বাণী,﴿ وَأُحِلَّ لَكُم مَّا وَرَآءَ ذَٰلِكُمۡ ٢٤ ﴾ [النساء: ٢٤]  “আর তা ছাড়া [বাকী সকল নারীদেরকে বিবাহ করা] তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে”।[43]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আলুসী বলেন: “এ আয়াতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, পূর্ববর্তী আয়াতে যে সমস্ত নারীদের বিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে তারা ব্যতীত অন্য সকল নারীকে পৃথক পৃথক অথবা একসাথে বিবাহ করা বৈধ”।
অতএব কুরআনুল করীমের এ হুকুমটি হল আম বা ব্যাপক যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উল্লেখিত ব্যক্তি ও নিয়ম ছাড়া অন্য সকল ব্যক্তি [নারী] ও নিয়মে বিবাহ করা বৈধ। মূলত: এ ব্যাপক হুকুমে বৈধ হলেও হাদিস দ্বারা একটি বিশেষ হুকুমকে নির্দিষ্ট করে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুহতে বর্ণিত, তিনি বলেন
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: «نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تُنْكَحَ الْمَرْأَةُ عَلَى عَمَّتِهَا أَوْ خَالَتِهَا،
 “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মহিলাকে তাঁর ফুপীসহ এবং কোন মহিলাকে তার খালা সহ একত্রে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন”।[44]
সুতরাং, এ হাদিস দ্বারা কুরআনের ব্যাপক বৈধতা হুকুমের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট হুকুমকে অবৈধ বলে খাস করা হল। এ হাদিস না হলে কুরআনের আম [ব্যাপক] হুকুমের দ্বারা কোন মহিলাকে তার ফুপীসহ এবং কোন মহিলাকে তার খালাসহ একত্রে বিবাহ করা বৈধ ছিল। কিন্তু হাদিস সে ব্যাপকতার মধ্য হতে এ খাস [নির্দিষ্ট] হুকুমটিকে অবৈধতার বিধান দিয়েছে। কারণ হাদিসও আল্লাহ তা’আলার ওহীর অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, প্রমাণিত হয় সুন্নাহ্ হল কুরআনের পরিপূরক, সুন্নাহ ছাড়া শুধু কুরআন দ্বারাই ইসলাম পূর্ণভাবে মানা সম্ভব নয়।

[খ] আল্লাহ তা’আলার বাণী, ﴿يُوصِيكُمُ ٱللَّهُ فِيٓ أَوۡلَٰدِكُمۡۖ لِلذَّكَرِ مِثۡلُ حَظِّ ٱلۡأُنثَيَيۡنِۚ ١١﴾ [النساء: ١١] “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান[45]।”

এ আয়াতের ব্যাপক ভাষা হতে বুঝা যায় যে, প্রতিটি পিতা-মাতা স্বীয় সন্তানদেরকে রেখে যাওয়া সম্পদের ওয়ারিশ বানাতে পারে। অনুরূপভাবে সকল প্রকার সন্তান পিতা-মাতার সম্পদের ওয়ারিশ হতে পারে। মূলত: হাদিস উক্ত আম [ব্যাপক] বিষয়টিকে খাস [নির্দিষ্ট] করে দিয়েছে, অর্থাৎ শুধু পিতা হলেই সন্তানকে ওয়ারিশ বানাতে পারবে না, অনুরূপ সন্তান হলেই পিতা-মাতার ওয়ারিশ হতে পারবে না, বরং কতগুলো বাধা রয়েছে, সে সব বাধামুক্ত পিতা-পুত্ররাই শুধু ওয়ারিশ বানাতে পারবে এবং ওয়ারিশ হতে পারবে। পবিত্র কুরআনে উক্ত বাধাসমূহ আলোকপাত করা হয়নি বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসে উক্ত বাধাসমূহ আলোকপাত করা হয়েছে, বাধাসমূহ নিম্নরূপ:

১. রিসালাত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ نُوْرِثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةً » “আমরা [নবী-রাসূল] কাউকে কোন ওয়ারিশ বানাই না বরং যা রেখে যাই তা সাধারণ দান [হিসাবে বায়তুল মালে জমা হবে]।”।[46] অর্থাৎ নবী-রাসূলগণ কাউকে ওয়ারিছ বানান না এবং তাঁদের পরিত্যক্ত সম্পদের কেউ ওয়ারিশ হওয়ার দাবী করতে পারে না। «»
২. ধর্মের ভিন্নতা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ يَرِثُ المُسْلِمُ الكَافِرَ وَلاَ الكَافِرُ المُسْلِمَ»
 “কোন মুসলমান কাফির এর ওয়ারিশ হতে পারে না অনুরূপভাবে কোন কাফির মুসলমানের ওয়ারিশ হতে পারে না।”[47]  অর্থাৎ সন্তান যদি মুসলমান হয় তাহলে কাফির পিতার ওয়ারিশ হতে পারবে না, অথবা সন্তান যদি কাফির হয় তাহলে মুসলমান পিতার ওয়ারিশ হতে পারবে না, অনুরূপভাবে পিতা-মাতাও সন্তানদের ওয়ারিশ বানাতে পারবে না।
৩. হত্যা ঘটিত কারণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, «لاَ يَرِثُ الْقَاتِلُ شَيْئًا» “হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির কোন সম্পদের ওয়ারিশ হতে পারবে না।”[48] অর্থাৎ হত্যাকারী যদি সন্তান হয় আর নিহত ব্যক্তি যদি পিতা-মাতা হয় তাহলে হত্যাকারী সন্তান স্বীয় পিতা-মাতার পরিত্যক্ত সম্পদের ওয়ারিশ হতে পারবে না।
অতএব পবিত্র কুরআনে পিতা-মাতাকে স্বীয় সন্তানদের ওয়ারিশ বানানোর যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে বিধানটি আম [ব্যাপক], যাহা হতে হাদিসে উল্লেখিত তিনটি বিষয়- রিসালাত, ধর্মের ভিন্নতা ও হত্যা খাস, অর্থাৎ ইহা ওই আম হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এ তিনটি ক্ষেত্রে কোন পিতা-মাতার অঢেল সম্পদ থাকলেও স্বীয় সন্তানদের ওয়ারিশ বানাতে পারবে না।

[গ] আল্লাহ তা’আলা বলেন, ﴿وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ فَٱقۡطَعُوٓاْ أَيۡدِيَهُمَا ٣٨﴾ [المائ‍دة: ٣٨]   “যে পুরুষ চুরি করে এবং যে নারী চুরি করে তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও”।[49]

এ আয়াতে চুরি করা বা চোর শব্দটি আম [ব্যাপক] ভাবে এসেছে, অর্থাৎ চুরি করলেই তার হাত কাটতে হবে। চাই নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ চুরি করুক বা তার চেয়ে কম করুক, অনুরূপভাবে সংরক্ষিত সম্পদ হতে চুরি করুক বা অসংরক্ষিত সম্পদ হতে চুরি করুক,  মোট কথা কুরআনের আয়াতে এমন আম বা ব্যাপকভাবে নির্দেশ এসেছে যাতে প্রমাণিত হয় যে, যে কোন চোর যে ভাবেই চুরি করুক না কেন সকল ক্ষেত্রে সকল চোরের হাত কাটতে হবে। মূলত: এ ব্যাপক [আম] বিধানটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের মাধ্যমে নির্দিষ্ট [খাস] হয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র ওই চোরের হাত কাটা হবে, যে সংরক্ষিত ও নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ চুরি করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
 عَنْ عَائِشَةَ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا تُقْطَعُ يَدُ السَّارِقِ إِلَّا فِي رُبْعِ دِينَارٍ فَصَاعِدًا»
“আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক চতুর্থাংশ দিনার সমপরিমাণ বা ততোধিক সম্পদ চুরি করা ছাড়া কোন চোরের হাত কাটা যাবে না”।[50]
পবিত্র কুরআনের নির্দেশে চুরি কৃত মালের পরিমাণ অনির্দিষ্ট থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় হাদিসে তাহা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি ১/৪ দিনার এর কম পরিমাণ সম্পদ চুরি করে তাহলে তার হাত কাটা যাবে না। অনুরূপভাবে কুরআনের নির্দেশে সম্পদ সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত কোন নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নাই, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
…”وَمَنْ سَرَقَ مِنْهُ شَيْئًا بَعْدَ أَنْ يُؤْوِيَهُ الْجَرِينُ، فَبَلَغَ ثَمَنَ الْمِجَنِّ، فَعَلَيْهِ الْقَطْعُ، “…..
“যে ব্যক্তি ফসল সংরক্ষণ করার পর চুরি করে, আর চুরিকৃত সম্পদ ঢালের সমমূল্য হয় তাহলে ওই চোরের হাত কাটা হবে।”[51]
এ হাদিসে মূলত: কুরআনের আম [ব্যাপক] হুকুমটি সুন্নাহর মাধ্যমে দুই ভাবে [পরিমাণ ও সংরক্ষণে] খাস [নির্দিষ্ট] হয়ে গেল।
অতএব কুরআন ও সুন্নাহর সম্পর্কের দ্বিতীয় অবস্থা হল সুন্নাহ কুরআনের মুতলাক [সাধারণ] হুকুমকে মুকাইয়াদ [সীমাবদ্ধ] হিসাবে, মুজমাল [সংক্ষিপ্ত] হুকুমকে মুফাসসাল [বিস্তারিত] হিসাবে এবং ‘আম [ব্যাপক] হুকুমকে খাস [নির্দিষ্ট] হিসাবে বর্ণনা করে থাক।
সুন্নাহ কুরআনুল করীমের গোপন রহস্য বর্ণনাকারী। মূলত: এটা আল্লাহ তা‘আলারই উদ্দেশ্য, এ জন্যেই তিনি স্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
  ﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]
“আর আপনার প্রতি উপদেশ বাণী [কুরআন] অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে আপনি তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিতে পারেন, ফলে তারা চিন্তা গবেষণা করবে”।[52]
এ আয়াত স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, সুন্নাহ হল পবিত্র কুরআনের বর্ণনা দানকারী। অতএব সুন্নাহ ব্যতীত কুরআন মেনে চলা অসম্ভব, এ জন্যই অনেক ইসলামী মনীষীগণ ইসলাম জানা ও মানার ক্ষেত্রে কুরআনের আগে সুন্নাহকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত হল সাহাবায়ে কিরামের উপদেশাবলি, ইমাম আল খতীব আল বাগদাদী স্বীয় সনদে বর্ণনা করেন: একদা সাহাবী ঈমরান বিন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু কিছু ব্যক্তিসহ [শিক্ষার আসরে] বসে ছিলেন। শ্রোতাদের মধ্য হতে একজন বলে ফেললেন, আপনি আমাদেরকে কুরআন ছাড়া অন্য কিছু শোনাবেন না। তিনি [সাহাবী] বললেন, নিকটে আস, অতঃপর বললেন, তুমি কি মনে কর, যদি তোমাদেরকে শুধু কুরআনের উপরই ছেড়ে দেয়া হয়? তুমি কি যোহরের সালাত চার রাকা’আত, আসর চার রাকাত, মাগরিব তিন রাক’আত, প্রথম দুই রাক’আতে কিরাত পাঠ করতে হয় ইত্যাদি সব কিছু কুরআনে খুঁজে পাবে? অনুরূপভাবে কাবার তাওয়াফ সাত চক্কর এবং সাফা মারওয়ার তাওয়াফ ইত্যাদি কি কুরআনে খুঁজে পাবে?অতঃপর বললেন: হে মানব সকল! তোমরা আমাদের [সাহাবীদের] নিকট হতে সুন্নাহর আলোকে এ সব বিস্তারিত বিধি-বিধান জেনে নাও। আল্লাহর কসম করে বলছি! তোমরা যদি সুন্নাহ মেনে না চল, তাহলে অবশ্যই ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।”
অতএব সঠিক পথ প্রাপ্ত হতে হলে কুরআনের সাথে কুরআনের রহস্য বর্ণনাকারী ইসলামের পূর্ণতা রূপ দানকারী সুন্নাহকে অবশ্যই আঁকড়ে ধরতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন!
তৃতীয় অবস্থা: তৃতীয় অবস্থা হল এমন সব বিষয় যাহা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন বর্ণনা আসেনি, সে সব বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস হালাল-হারামের হুকুম বর্ণনা করে দিয়েছে, যেমন- কোন মহিলাকে তার খালাসহ অথবা ফুঁপিসহ একত্রে দুজনকে বিবাহ করা হাদিসে হারাম করা হয়েছে। বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম করার বিধান এবং দাদীর জন্য মিরাছী অংশ ইত্যাদি হুকুম গুলি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন নির্দেশনা নেই, অথচ হাদিসে তার বৈধতা ও অবৈধতা বর্ণনা করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনের সাথে সুন্নাহর সম্পর্কের যে তিনটি অবস্থা রয়েছে তন্মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থায় সকল আলেম সমাজ একমত কিন্তু এ তৃতীয় অবস্থা সম্পর্কে কিছু আলেম সমাজ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তবে হাদিসে ওই সব বিধান পাওয়াটাকে কেউ অস্বীকার করেন নি। তাই অধিকাংশ আলেম সমাজ তৃতীয় অবস্থা সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়ূম [রাহিমাহুল্লাহ] কুরআনের সাথে সুন্নাহর সম্পর্কের তিনটি অবস্থা বর্ণনা করার পর বলেন: কুরআনের চেয়ে হাদিসে যে সব বিধান অতিরিক্ত বর্ণিত হয়েছে [অর্থাৎ, তৃতীয় অবস্থাটি] এটা মূলত: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেই ওই সব বিধান প্রবর্তিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর [সুন্নাহর] আনুগত্য অপরিহার্য, কোন ক্রমেই তাহা অমান্য করা যাবে না। আর এটা কুরআনের উপর কোন বাড়াবাড়িও নয়, বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য বিষয়ক আল্লাহর নির্দেশ পালনেরই অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে যদি তাঁর আনুগত্য না করা হয়, তাহলে তাঁর আনুগত্যের কোন অর্থই হয় না এবং তাঁর আনুগত্যের স্বতন্ত্রতা বর্জিত হয়। আর কুরআনের সাথে মিলে যাওয়া বিষয় ছাড়া কুরআনের অতিরিক্ত বিষয়ে যদি তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা না হয় তাহলে তাঁর আনুগত্যের বিশেষত্ব কোথায়? অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন,
 ﴿ مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ ٨٠ ﴾ [النساء : ٨٠]  [
“যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য করল সে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা’আলারই আনুগত্য করল”।[53]
অতএব কোন জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে সম্ভব যে, তিনি কুরআনের চেয়ে অতিরিক্ত বিধান সম্বলিত হাদিস গ্রহণ করবেন না? তিনি কি কোন মহিলাকে স্বীয় খালা বা ফুপীর সাথে একত্রে দু’জনের বিবাহ নিষিদ্ধের হাদিস, রক্ত বা বংশীয় ভাবে যা হারাম হয় দুগ্ধ পানের মাধ্যমে তাহা হারামের হাদিস, খিয়ারে শর্তের হাদিস,শুফায়ার হাদিস, স্বগৃহে বসবাস কালে বন্ধকের হাদিস গ্রহণ করেন না? অথচ এ সবই কুরআনের চেয়ে অতিরিক্ত বিধান সম্বলিত হাদিস [অর্থাৎ এ বিধানগুলি কুরআনে বর্ণিত হয়নি শুধু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে]। অনুরূপভাবে দাদীর মিরাছের হাদিস, বিবাহিত কৃতদাসের স্বাধীনতার হাদিস, মেয়েদের ঋতু অবস্থায় রোযা, সালাত নিষিদ্ধের হাদিস, রোযা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটলে কাফফারা ওয়াজিবের হাদিস, বিধবা মহিলার ইদ্দত পালন কালে শোক পালনের হাদিস গ্রহণ করেন না?অথচ এসব হাদিসই কুরআনের অতিরিক্ত বিধান সম্বলিত হাদিস”। বস্তুত: কুরআনের নির্দেশেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলা অপরিহার্য চাই তা কুরআনে থাকুক আর নাই থাকুক।
কুরআনের নির্দেশ:  ﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ ٧ ﴾ [الحشر: ٧]  “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের যা দিয়েছেন তোমরা তা গ্রহণ কর এবং যা হতে বারণ করেছেন তা হতে বিরত থাক।”[54]
কুরআনের অন্যত্র এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল সিদ্ধান্ত [বিধি-বিধান] সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া ছাড়া ঈমানদার হওয়া সম্ভব নয়, তা কুরআনে আছে বা নাই? এ প্রশ্নের কোন সুযোগ নেই।
আল্লাহ তা’আলা বলেন:
 ﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]
“তোমার রবের কসম তারা কখনও ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ফায়সালা কারী হিসাবে মেনে নেয়। অতঃপর তোমার ফায়সালার ব্যাপারে তাদের মনে কোন দ্বিধা-সংকোচ থাকবে না এবং সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণ করে নিবে[55]।”
অতএব কুরআনের নির্দেশেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন [কুরআন ও সকল প্রকার সহীহ হাদিস] সবই প্রতিটি মু’মিন নর-নারীর গ্রহণীয় ও পালনীয় বিষয়, আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন। আমীন!
 পঞ্চম পরিচ্ছেদ
হাদিসের ক্ষেত্রে সালফে সালেহ্/সাহাবী ও তাবেঈদের গুরুত্ব প্রদান

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসকে সর্বযুগের ইসলামী মনীষীগণ যথাসাধ্য গুরুত্ব প্রদান করেছেন, তবে এক্ষেত্রে সর্ব প্রথম অবদান রেখেছেন ইসলামী মনীষীদের অনুকরণীয় ও অনুশীলনীয় অগ্রজ সালফে সালেহ্ সাহাবী ও তাবেয়ীগণ, তাঁরা স্বীয়যুগে সর্বশ্রম দিয়ে শিক্ষা, গবেষণা, সংরক্ষণ, সংকলন, প্রচার-প্রসার এবং বাস্তব প্রয়োগসহ সকল পন্থায় সুন্নাহর পূর্ণ গুরুত্ব প্রদান করে এক নযীর স্থাপন করেছেন। নিম্নে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হল:

সাহাবীদের যুগে সুন্নাহর গুরুত্ব প্রদান

সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদত্ত কুরআনের ব্যাখ্যার আলোকে ইসলামের হুকুম আহ্কাম শিক্ষা লাভ করতেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  ﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤﴾ [النحل: ٤٤]  “আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া বিষয়গুলি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যাদান করেন”[56]
আল্লাহ আরও বলেন,  ﴿ وَمَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ ٱلَّذِي ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ لِّقَوۡمٖ يُؤۡمِنُونَ ٦٤ ﴾ [النحل: ٦٤]
এ জন্যই সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি কথা ও কাজ, ইবাদাত বন্দেগী এবং আচার-আচরণ অতি গুরুত্ব ও মনোযোগ সহকারে লক্ষ করতেন এবং ইসলামের হুকুম আহ্কাম তাঁর কাছ থেকে যব্ত-রপ্ত করে নিতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ইবাদতের নিয়মাবলী শিক্ষা নিতে হবে এ জন্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ প্রদান করেছেন, صَلُّو كَمَا رَأَيْتُمُوْنِيْ أُصَلِّيْ “তোমরা সেভাবে সালাত সম্পাদন কর, যে ভাবে আমাকে সম্পাদন করতে দেখেছ”। তিনি আরও বলেন, خُذُوْا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُمْ “তোমরা আমার হজ্ব সম্পাদনের পদ্ধতি হতে তোমাদের হজ্ব সম্পাদনের পদ্ধতি জেনে নাও”।
সাহাবীগণ এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতকে সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেই গ্রহণ করতেন। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছাড়াই তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কার্যসমূহের অনুসরণ করতেন। যেমন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি বানালেন সাহাবীগণ দেখাদেখি স্বর্ণের আংটি বানালেন, অতঃপর যখণ স্বর্ণ পুরুষদের জন্য হারাম হয়ে গেল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বর্ণের আংটি খুলে ফেললেন, দেখাদেখি সকল সাহাবীগণও আংটি খুলে ফেললেন”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় এভাবেই সাহাবীগণ তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার প্রাণ-পণ চেষ্টা করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর সাহাবীগণ তাঁর সুন্নাতকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার জন্য বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একে অপরের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহে প্রতিযোগিতায় অবতরণ করতেন। এমনকি সুদূর পথ অতিক্রম করেও হাদিস শিক্ষা হতে বিরত হননি। একটি হাদিসের জন্য এক মাসের পথ অতিক্রম করে হলেও তা সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন। যেমন- সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু একটি হাদিস শিক্ষার জন্য মদিনা হতে শাম এক মাসের পথ অতিক্রম করে সেখানে গেছেন।
আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ, কথা ও কাজ বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপরের কাছে কখনও বর্ণনা করতেন না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে যেমন উৎসাহ প্রদান করেছেন, তেমনি হাদিস বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় এর ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَؤّْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার উপর কোন মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান নির্ধারণ করে নিলো”।[57]  তিনি আরও বলেন:
كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ
“একজন ব্যক্তির মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যাকিছু শুনে [সত্য-মিথ্যা যাচাই ছাড়া] তাহাই অন্যের কাছে বর্ণনা করে”।[58]
অতএব সাহাবীগণ যেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ সংগ্রহ ও প্রচার-প্রসারে আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন তেমনি আবার ভুল-ত্রুটি ঘটতে পারে এ আশংকায় চরম সতর্ক ছিলেন। কোন কিছু শুনে বা দেখে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বর্ণনা করতেন না। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ খাদেম সাহাবী আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন:
لَوْلاَ أَنِّي أَخْشَى أَنْ أُخْطِئَ لَحَدَّثْتُكُمْ بِأَشْيَاءَ سَمِعْتُهَا مِنْ رَسُولِ اللهِ أَوْ قَالَهَا رَسُولُ اللهِ وَذَاكَ أَنِّي سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“আমার যদি ভুল ত্রুটির আশংকা না হত তাহলে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অনেক কিছু বর্ণনা করতাম যা তাকে বলতে শুনেছি, কিন্তু ভয় হয় যে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার উপর মিথ্যা রোপ করল সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিলো”।[59]
এমনিভাবে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবনু ওমার সহ অনেক সাহাবী ভুল-ত্রুটির আশংকায় অনেক হাদিস বর্ণনা করেন নি।
অতএব এতে প্রতীয়মান হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ হাদিস সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারে অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

 

তাবেঈদের যুগে সুন্নাহর গুরুত্ব প্রদান
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের বিদায়ের পরই শুরু হল তাবেঈনদের যুগ। তাবেঈদের যুগের শুরুতেই প্রকাশ পেল ইসলামের নামে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এ ষড়যন্ত্র মূলত: সাহাবীদের পরেই নয় বরং তা শুরু হয়েছে আরও আগেই। ইসলামের শত্রুরা যখন প্রকাশ্য মুকাবিলায় ব্যর্থতার শিকার হল,তখন শুরু হল সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। এটা মূলত: দ্বিতীয় খলীফা আমীরুল মুমিনিন ওমার রাদিআল্লাহু আনহু-কে মাজুসী/অগ্নিপূজক এর মাধ্যমে হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ খলীফার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একে একে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একনিষ্ঠ সহচর বা সাহাবীদের বিদায়ের পাশাপাশি ইসলাম আগ্রাসী অপশক্তির ছোবলের তেজ আরও প্রখর হতে লাগল। খাওয়ারেজ, রাফেযী, মুরজিয়া ও কাদেরীয়া ইত্যাদি ফেৎনার মুখোস উন্মোচন হল। ইসলামী বিষয়াদীতে সংশয়-সন্দেহ অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগল। এমতাবস্থায় সুন্নাহ সংরক্ষণ একটি জরুরী ও জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এ সন্ধিক্ষণে তাবেঈগণ নানাভাবে সুন্নাহ সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। সুন্নাহ সংরক্ষণে তাঁদের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহ নিম্নরূপ :
১. العناية بحفظها হাদিস মুখস্থ করণে গুরুত্ব প্রদান।
২. السوال عن الاسناد হাদিসের সনদ/ সূত্রের সঠিকটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ, অর্থাৎ সনদ যাচাই করণ।
البحث في أحوال الرجال ونقلة الأخبار  হাদিস বর্ণনাকারী/রাবীদের জীবন-চরিত সম্পর্কে গবেষণা ও বিশ্লেষণ।
৪.تدوين السنة الذي بدأ بصحف وأجزاء ثم تطور বিভিন্ন পুস্তিকা ও খণ্ড খণ্ড গ্রন্থে হাদিস সংকলন, যাহা পরবর্তীতে বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্ত্বা ইত্যাদি সংকলনে রূপলাভ করে।
সাহাবীদের শেষ লগ্নে তাবেঈদের যুগে বিদ‘আত, খোরাফাত ইত্যাদির বিকাশ ঘটলে সরলভাবে হাদিস গ্রহণ করা হত না, বরং পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করে ছিকাহ অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত রাবী/বর্ণনাকারীর হাদিসই শুধু গ্রহণ করা হত। কারণ এ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামনিজেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ: يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنْ الأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلاَ آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لاَ يُضِلُّونَكُمْ وَلاَ يَفْتِنُونَكُمْ
“সাহাবী আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, শেষ যুগে কতক মিথ্যুক দজ্জালের আগমন ঘটবে, তারা তোমাদের কাছে এমন সব হাদিস পেশ করবে, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষরাও কখন শোনেনি, অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যাও, তারা যেন তোমাদেরকে পথভ্রষ্টটা ও ফিতনা-ফ্যাসাদে নিপতিত করতে না পারে।[60]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সতর্ক বাণীর আলোকে সাহাবীদের শেষ যুগে এবং তাবেঈদের যুগে হাদিস গ্রহণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম শুনলেই যথেষ্ট মনে করা হত না, বরং খুবই সতর্কতার সাথে যাচাই-বাছাই করে হাদিস গ্রহণ করা হত। ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] সাহাবী ও তাবেঈদের হাদিস গ্রহণের অবস্থাসমূহ স্বীয় গ্রন্থ সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় সুন্দরভাবে আলোকপাত করেছেন, তন্মধ্যে কয়েকটি বর্ণনা নিম্নে প্রদত্ত হল:

[১] ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] স্বীয় সনদে প্রসিদ্ধ তাবেঈ মুজাহিদ [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: বাশীর বিন কা’ব আল আদাবী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু-এর কাছে আসলেন এবং হাদিস বর্ণনা শুরু করলেন, বলতে লাগলেন: قَالَ رَسُولُ اللهِ ، قَالَ رَسُولُ اللهِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ইত্যাদি” কিন্তু সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু তাকে হাদিস বর্ণনার কোন সুযোগ দিলেন না। এমনকি তার দিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না। বাশীর বিন কা’ব বললেন, হে ইবনু আব্বাস! কি ব্যাপার, আপনি আমার হাদিস শুনছেন না কেন? আমি আপনাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদিস বর্ণনা করছি, আর আপনি কোন কর্ণপাত করছেন না? তার জবাবে ইবনু আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, প্রথম পর্যায়ে কোন ব্যক্তিকে যখনই বলতে শুনতাম যে, قَالَ رَسُولُ اللهِ “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- সাথে সাথে তার কথায় আমরা মনোযোগী হতাম এবং খুব গুরুত্ব দিয়ে তার কথা শুনতাম, কিন্তু যখন মানুষ বিভিন্ন ছলচাতুরী শুরু করল,তখন হতে আমাদের জানা বিষয় ছাড়া সাধারণ মানুষ হতে অন্য কিছু শুনি না এবং গ্রহণ করি না”।
এ বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস গ্রহণে তাঁরা কত সতর্ক ছিলেন। সাহাবী ছাড়া অন্য কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে বর্ণনা করলেও নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সে হাদিস গ্রহণ করতেন না।

[২] প্রসিদ্ধ তাবেঈ মুহাম্মদ বিন সীরিন [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণিত তিনি বলেন:

 إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ “নিশ্চয় হাদিসের জ্ঞান হল দ্বীনের অন্যতম অংশ, অতএব ভালভাবে লক্ষ কর তোমরা কাদের হতে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ”।

[৩] তিনি আরও বলেন, “হাদিসের সনদ/সূত্র ও রাবী বা বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হত না, কিন্তু যখন হতে [কাদেরীয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া ও রাফেযী ইত্যাদি বিদ’আতের] ফিতনা প্রকাশ পেল তখন হতে জিজ্ঞাসা শুরু হল: سموا لنا رجالكم… “যাদের বরাতে হাদিস বর্ণনা করছ তাদের নাম উল্লেখ কর”,ব্যক্তিরা যদি সুন্নাতপন্থী হতেন তাহলে তাদের হাদিস গ্রহণ করা হত, আর যদি বিদ‘আাতী হতেন তাহলে তাদের হাদিস প্রত্যাখ্যান করা হত”।

[৪] আব্দান বিন উছমান মারওয়াযী [রাহিমাহুল্লাহ] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আব্দুল্লাহ বিন মুবারককে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: اَلإِسْنَادُ مِنْ الدِّينِ لَوْلاَ الإِسْنَادُ لَقَالَ مَنْ شَاءَ مَا شَاءَ “হাদিসের সনদ/সূত্র দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ যদি এ সনদ বর্ণনার ব্যবস্থা না থাকত তাহলে যার যা ইচ্ছা হত তাই বলত”।

তাবেঈদের হাদিস সংগ্রহে এবং সংরক্ষণে এ নীতি অবলম্বন বিদাতী চক্রের ষড়যন্ত্র এবং ইসলামের শত্রুদের সুদূর পরিকল্পিত চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। হাদিসের নাম দিয়ে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বরাতে মিথ্যাচারের পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সনদ বিহীন বর্ণনার সুযোগ ও মিথ্যুক দজ্জালদের দাজ্জালি ও মিথ্যাচার বন্দ হয়ে যায়, বা চালু থাকলেও পরিশেষে মিথ্যা প্রকাশ পেয়ে যায়।
তাবেঈদের এ নীতি অবলম্বন করে সর্বপ্রথম হাদিস শাস্ত্রের নীতিমালা প্রণয়ন করেন ইমাম শাফেয়ী [রাহিমাহুল্লাহ] তাঁর “আর রিসালাহ” ও “কিতাবুল উম্ম” গ্রন্থদ্বয়ে। এরপর এ শাস্ত্রের গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমান ইমাম বুখারী [রাহিমাহুল্লাহ] ইমাম মুসলিম [রাহিমাহুল্লাহ] সহ আরও অনেকে। আল্লাহ তা’আলা তাদের সকলকে জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন!
 
৬ষ্ট পরিচ্ছেদ
সুন্নতের তাজিম ও তার উপর আমল করা ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাদের পরবর্তীদের বর্ণনা:
সুন্নতের তাজীম ও তার উপর আমল করা ওয়াজিব হওয়া বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাদের পরবর্তীদের কিছু কথা আলোচনা করা হল। যেমন, বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর পর আরবের কিছু লোক মুরতাদ হল। আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু সাহসিকতার সাথে বললেন, আল্লাহর কসম যে ব্যক্তি সালাত ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তার কথা শুনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, আপনি তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন, অথচ রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করে বলেন, أمِرْتُ أَنْ أقَاتِلَ النَّاسَ حَتى يَقُولُوا لا إِلهَ إِلا الله فَإِذا قَالوها عَصَمُوا مِني دِمَاءَهُم وَأَموَالَهُم إِلا بحقَّها“আমাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ না বলা পর্যন্ত মানুষের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যখন সে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, তার জান মাল নিরাপদ তবে ঈমানের দাবী অনুযায়ী”।
তার কথা শোনে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, যাকাত কি আল্লাহর হক নয়? আল্লাহর কসম যদি একটি রশিও যা রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে যাকাত হিসেবে প্রদান করা হত তা দিতে যদি কেউ অস্বীকার করে, আমি অস্বীকার করার কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তারপর ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, আমি বুঝতে পারলাম, আল্লাহ তা’আলা আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু এর অন্তরকে যুদ্ধের জন্য খুলে দিয়েছেন এবং এটিই হক। সাহাবীরা তার আহ্বানে সাড়া দিলেন, তারা মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তাদের পুনরায় ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনেন। আর যারা মুরতাদ হওয়ার উপর অবিচল থাকে তাদের তিনি হত্যা করেন। এ ঘটনার মধ্যে সুন্নতের তাজীম করা ও তার উপর আমল করা জরুরি হওয়া বিষয়ে সু-স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
একজন দাদী আবু বকরের নিকট এসে সে তার উত্তরাধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহু বললেন, তোমার জন্য আল্লাহর কিতাবে কোন অংশ বর্ণিত হয় নাই। আর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমার জন্য কোন অংশ বর্ণনা করেছেন বলে আমার জানা নাই। তবে আমি মানুষকে জিজ্ঞাসা করব, তারপর তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করেন, তখন একজন সাহাবী সাক্ষ্য দিল যে, নবী করীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাদিকে সুদুস-ছয় ভাগের একভাগ দিয়েছেন। তারপর তিনি দাদির জন্য সুদুস-ছয় ভাগের একভাগের ফায়সালা করেন।
ওমর রাদিআল্লাহু আনহু তার আমেলদের-কর্মকর্তাদের আল্লাহর কিতাব দ্বারা মানুষের মাঝে বিচার ফায়সালা করার নির্দেশ দিতেন। যখন আল্লাহর কিতাবে ফায়সালা খুঁজে না পেতেন, তখন আল্লাহর রাসূলের সূন্নাত দ্বারা ফায়সালা করার নির্দেশ দিতেন। যখন গর্ভের সন্তানকে তাদের কারো কোন কু-কর্মের কারণে মৃত অবস্থায় প্রসব করে তখন তার বিধান কি বিষয়টি সম্পর্কে তার নিকট কোন সমাধান না থাকাতে তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করেন। তখন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ রাদিআল্লাহু আনহু ও মুগীরা ইবনে শুবা রাদিআল্লাহু আনহু দাড়িয়ে বললেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে একটি চিত কপাল বিশিষ্ট গোলাম আযাদ করা অথবা একজন বাদির আযাদ করার ফায়সালা করেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর ঘরে মহিলার ইদ্দত পালন করার বিষয় ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু এর অজানা থাকাতে ফায়সালা দেয়া তার নিকট কঠিন মনে হল, তখন রবিয়া বিনতে মালেক বিন সিনান আবু সাঈদ রাদিআল্লাহু আনহু এর বোন সে বলল, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালন করার নির্দেশ দেন। তারপর ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু মহিলার কথা অনুযায়ী বিষয়টির ফায়সালা করেন। অনুরূপভাবে ওলিদ বিন উকবার উপর মদ পান করার অপরাধে হদ কায়েম করার ফায়সালা সুন্নাত দ্বারাই করেন। আলী রাদিআল্লাহু আনহু এর নিকট যখন এ সংবাদ পৌঁছল যে, ওসমান রাদিআল্লাহু আনহু হজ্জে তামাত্তু হতে নিষেধ করেন, আলী রাদিআল্লাহু আনহু হজ ও ওমরা উভয়ের এহরাম বাধেন এবং বলেন, আল্লাহর রাসূলের সূন্নাতকে আমি কারো কথায় ছাড়বো না। এক লোক আবু বকর ও ওমর রাদিআল্লাহু আনহু কথা দ্বারা আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের নিকট তামাত্তু হজ বিষয়ে দলীল পেশ করলে, ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি আশংকা করছি তোমাদের উপর আসমান থেকে পাথরের বৃষ্টির মত বিপর্যয় নেমে আসার। আমি তোমাদেরকে বলি আল্লাহর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আর তোমরা বল আবু বকর ও ওমর রাদিআল্লাহু আনহু বলেন। যদি সুন্নাতের বিপরীতে আবু বকর ও ওমরের কথা দিয়ে দলীল পেশ করলে, তার উপর শাস্তির আশংকা করা হয়, তাহলে যারা আবু বকর ও ওমর থেকে নীচের লোক তাদের কথায় অথবা নিজের মতামত ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে আল্লাহর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সূন্নাতকে ছেড়ে দেন তাদের পরিণতি কি হতে পারে। যখন কিছু লোক আব্দুল্লাহ বিন ওমরের নিকট সূন্নাত বিষয়ে বিতর্ক করল, তখন আব্দুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু তাদের বললেন, আমরা কি ওমরের আনুগত্য করার জন্য নির্দেশিত নাকি আবু বকরের আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশিত।
ইমরান বিন হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু যখন হাদিস আলোচনা করিতেছিল, তখন এক ব্যক্তি তাকে বলল, আপনি আমাদের আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করেন। এ কথা শোনে তিনি খুব ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলেন, সূন্নাত আল্লাহর কিতাবেরই ব্যাখ্যা যদি সূন্নাত না হত, তাহলে আমরা জোহরের সালাত চার রাকাত, মাগরিবের সালাত তিন রাকাত, ফজরের সালাত দুই রাকাত জানতে পারতাম না। যাকাতের বিধান বিস্তারিত জানতে পারতাম না এবং শরিয়তের অন্যান্য বিষয়গুলো জানার সুযোগ হত না।
সাহাবীদের থেকে সুন্নতের তাজীম ও তার উপর আমল করা ওয়াজিব হওয়া ও তার বিরোধিতা করার পরিণতি বিষয়ে বর্ণনা অনেক। যেমন, আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিআল্লাহু আনহু যখন এ হাদিস বর্ণনা করেন,
لا تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللهِ مَسَاجِدَ اللهِ    তোমরা আল্লাহর বন্দীদের মসজিদে গমনে বাধা দিও না,[61] তখন তার ছেলেরা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা তাদের মসজিদে গমনে বাধা দিব। তাদের কথা শোনে আব্দুল্লাহ খুব ক্ষুব্ধ হলেন এবং তাদের কঠিন বকা দিলেন এবং বললেন, আমি তোমাদের বলছি আল্লাহর রাসূল বলছে আর তোমরা বলছ আমরা অবশ্যই তাদের বাধা দেব।
রাসূলের সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মুগাফ্ফাল যখন তার কতক আত্মীয়দের দেখতে পেলেন, তারা খজফ করছেন, তিনি তাদের নিষেধ করলেন এবং তাকে তিনি বলেন,  نهى الخذف وقال إٍنه لا يصيد صيدًا ولا ينكأ عدوا ولكنه يكسر السن ويفقأ العين   “রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর নিক্ষেপ করতে নিষেধ করে এবং তিনি বলেন, এতে কোন শিকারীকে শিকার করা যায় না, কোন দুশমণকে প্রতিহত করা যায় না বরং তাতে দাঁত আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং চোখ নষ্ট হয়”।[62] তারপর তাদের আবারও পাথর নিক্ষেপ করতে দেখে বলেন, আমি তোমাদের সাথে কখনোই কথা বলব না। আমি তোমাদেরকে খবর দিলাম আল্লাহর রাসূল পাথর নিক্ষেপ করেছেন তারপরও তোমরা পাথর নিক্ষেপ কর?।
ইমাম বাইহাকী রাহিমাহুল্লাহ আইয়ুবে সুখতিয়ানি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে সূন্নাত সম্পর্কে আলোচনা শোনাও, তখন সে বলে, তুমি আমাকে কুরআনের আলোচনা শোনাও, মনে রাখবে লোকটি গোমরাহ।
আল্লামা আওযায়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সূন্নাত হল, আল্লাহর কিতাবের বিচারক অথবা সূন্নাত আল্লাহর কিতাবের বিধান সমূহের সম্পূরক অথবা যে সব বিধান আল্লাহর কিতাবে নাই সে সব আহকামের বর্ণনা। যেমন, আল্লাহর বাণী-
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤﴾ [النحل: ٤٤]
আর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী أَلا إِني أوتِيتُ الكِتابَ ومثلَه مَعَهُ ،  “মনে রাখবে আমাকে কিতাব দেয়া হয়েছে, এবং তার সাথে তার মত আরও দেয়া হয়েছে”।[63] তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম বাইহাকী রাহিমাহুল্লাহ আমের আশ-শাআবী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি কতক লোককে বলেন,إِنما هلكتم في حين تركتم الآثار  অর্থাৎ সহীহ হাদিস সমূহ।
ইমাম বাইহাকী রাহিমাহুল্লাহ আওযায়ী রাহিমাহুল্লাহ থেকে আরও বর্ণনা করেন, তিনি তার কতক সাথীকে বলেন, যখন তোমাদের নিকট রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন হাদিস পৌঁছে, তখন আর কোন কথা বলা থেকে তুমি বিরত থাক। কারণ, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মুবাল্লিগ ছিলেন।
ইমাম বাইহাকী রাহিমাহুল্লাহ বিশিষ্ট ইমাম সূফিয়ান বিন সাঈদ রাহিমাহুল্লাহ থেকে আরও বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইলমই হল, হাদিসের ইলম।
ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবরের দিক ইশারা করে বলেন, একমাত্র এ কবর ওয়ালা ছাড়া আমরা সবাই বিতর্কিত।
ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে হাদিস সামনে আসে তখন তা মাথা ও চোখের উপর।
ইমাম আবু শাফী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও আমি যদি সে অনুযায়ী আমল না করি, তবে মনে রাখবে, আমি তোমাদের সাক্ষ্য করে বলছি, আমার জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, আমি যখন কোন কথা বলি, আর হাদিস আমার কথার বিপক্ষে তাহলে আমার কথাকে তোমরা দেয়ালের ওপাশে নিক্ষেপ কর।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ তার কতক সাথীকে বলেন, তোমরা আমার তাকলীদ করো না, মালেক রাহিমাহুল্লাহ ও শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ তাকলীদ করো না, তোমরা আমরা যেখান থেকে গ্রহণ করেছি, সেখান থেকে গ্রহণ কর। তিনি আরও বলেন, আমি সে সব লোকদের বিষয়ে আশ্চর্য বোধ করি, যারা হাদিসের সনদ সম্পর্কে জানে হাদিসটি সহীহ কিনা তাও জানে তারপরও সুফিয়ানের নিকট যায় তার মতামতের জন্য। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন,
  ﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣﴾ [النور : ٦٣]
তোমাদের মধ্যে যারা চুপিসারে সরে পড়ে আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জানেন। অতএব যারা তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌছার ভয় করে।[64]
তিনি আরও বলেন, তোমরা কি জান ফিতনা কি? ফিতনা হল আল্লাহর সাথে শিরক করা, হতে পারে যখন কোন ব্যক্তি রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন কথাকে প্রত্যাখ্যান করবে, তখন তার অন্তরে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি বক্রতা ডেলে দেয়া হবে, তখন সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা’আলার বাণী- হে মুমিনগণ, তো
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [النساء : ٥٩]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টত্বর[65]।” বিষয়ে বিশিষ্ট তাবেয়ী মুজাহিদ বিন জাবার হতে ইমাম বাইহাকী বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর দিকে প্রত্যর্পণ অর্থ আল্লাহর কিতাবের দিক প্রত্যর্পণ অনুরূপ আল্লাহর রাসূলের দিক প্রত্যর্পণ অর্থ সুন্নতের দিক প্রত্যর্পণ।
ইমাম বাইহাকী যুহরী রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা নকল করেন, তিনি বলেন, আমাদের পূর্বের আলেমগণ বলতেন, সূন্নাতকে আঁকড়ে ধরা নাজাত। আল্লামা ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় কিতাব রাওজাতুন নাজেরে উসুলুল আহকাম বর্ণনায় লেখেন, দলীল হিসেবে দ্বিতীয় মূলনীতি হল, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সূন্নাত। আর রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা প্রমাণ কারণ, তার মুজিযাসমূহ তিনি সত্যবাদী তার প্রমাণ। আর আল্লাহ তা’আলা তার অনুকরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন আর যারা তার আদেশের বিরোধিতা করেন, তাদের সতর্ক করেছেন।
হাফেজ ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা’আলার বাণী-
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور : ٦٣]
তোমাদের মধ্যে যারা চুপিসারে সরে পড়ে আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে জানেন। অতএব যারা তার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌছার ভয় করে।[66] র তাফসীরে বলেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমর এর অর্থ তার প্রদর্শিত পথ, তার অনুসৃত পদ্ধতি, তার দেখানো নিয়ম, তার সূন্নাত ও তার শরীয়ত। সুতরাং যে কোন কথা ও কর্ম তার কথা ও কর্মে সাথে তুলনা করা হবে, যে কথা ও কর্ম তার কথার সাথে মিলবে তা গ্রহণ করা হবে আর যে কথা ও কর্ম তার সাথে মিলবে না তার কথা ও কর্ম তা প্রত্যাখ্যান করা হবে, সে যেই হোক না কেন। যেমন, বুখারি মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবসমূহে বর্ণিত রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  مَنْ عَمِلَ عَمَلًا ليسَ عَليهِ أَمْرُنا فَهُوَ رَدّ   যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে, যার উপর আমার নির্দেশনা নাই তা প্রত্যাখ্যাত”।[67]
যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে বা গোপনে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনিত দ্বীনের বিরোধিতা করে, সে যেন ভয় করে এবং সতর্ক হয়, আল্লাহর এ বাণী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ তাদের অন্তরে ফিতনা অর্থাৎ কুফর, নেফাক বা বিদআত ডেলে দেয়া হতে পারে। অথবা أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌদুনিয়াতে তার কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে। যেমন, তাদের হত্যা করা হতে পারে, অথবা বন্দী করা হতে পারে, অথবা তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করা হতে পারে।
যেমন, ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহ একটি হাদিস বর্ণনা তিনি বলেন, আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু আমাদের হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
مثَلي وَمثَلُكمْ كمَثَلِ رجلٍ اسْتَوْقَدَ نارًا فَلمّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهَا جَعَلَ الفراشُ وهَذِهِ الدّوابُّ اللائِي يَقَعْنَ في النَّار يَقَعْنَ فِيهّا وَجَعَلَيَحْجُزُهُنّ وَيَغْلِبْنَهُ فَيَقْتحِمْنَ فِيَها قَالَ فَذَلِك مَثَلي وَمَثَلَكمْ أَنا آخُذُ بحَجْزِكُم عَن النَّار هَلُمّ عَن النارِ فَتَغْلِبُوني وَتقْتَحِمُونَ فِيهَا
আমার দৃষ্টান্ত ও তোমাদের দৃষ্টান্ত এমন এক ব্যক্তির মত, যে আগুন জ্বাললও, তারপর যখন আগুনের আশ-পাশ আলোকিত হল, তখন কৃট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড় যে গুলো আগুনের মধ্যে ঝাপ দেয়, তাতে তারা পড়তে আরম্ভ করল। আর লোকটি তাদের বাধা দিল, কিন্তু তারা তাকে পরাহত করল এবং আগুনেই পুড়ে মারা যাচ্ছিল। রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার দৃষ্টান্ত লোকটির মতই; আমি তোমাদের কোমর ধরে তোমাদের আগুন থেকে দূরে সরাবো, বলতে থাকব, আগুন! আগুন! কিন্তু তোমরা আমাকে পরাহত করবে, ফলে তোমরা আগুনেই জ্বলবে।[68] বুখারি ও মুসলিম হাদিসটিকে আব্দুর রাজ্জাকের হাদিস থেকে গ্রহণ করেন। আল্লামা সুয়ুতী রাহিমাহুল্লাহ তার স্বীয় রিসালা মিফতাহুল জান্নাহ ফিল ইহতিজাজ বিসসূন্নাহ কিতাবে লেখেন-
তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করুন, যে ব্যক্তি রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস চাই তা তার কথা হোক বা কর্ম দলীল হওয়াকে অস্বীকার করল, সে কুফরি করল, সে ইসলামের বন্ধন থেকে বের হয়ে গেল। তার হাসর ইয়াহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে হবে অথবা কাফের ফিরকার সাথে হবে।
সুন্নতের গুরুত্ব, সুন্নতের উপর আমল করা ওয়াজিব হওয়া এবং সুন্নতের বিরোধিতা করা হতে সাবধানতা অবলম্বন করা বিষয়ে সাহাবী তাবেয়ী ও তাদের পরবর্তী আহলে ইলম থেকে অসংখ্য বাণী বর্ণিত। আশা করি, আমরা এখানে যে সব আয়াত, হাদিস ও বাণী উল্লেখ করেছি, তা হকের অনুসন্ধান কারীর জন্য যথেষ্ট। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য এবং সমস্ত মুসলিমদের জন্য তাওফিক কামনা করি, এমন সব আমলে যা তাকে খুশি করে আর নিরাপত্তা কামনা করি তার বিক্ষুব্ধ হওয়া কারণ সমূহ হতে। আর আল্লাহ কাছে আমাদের কামনা তিনি যেন আমাদের সবাইকে সঠিক পথের হিদায়েত দেন। নিশ্চয় তিনি শ্রবণকারী ও নিকটবর্তী।
الله وسلم على عبده ورسوله نبينا محمد وعلى آله وأصحابه وأتباعه بإحسان

[1] [সূরা ইমরান: ১৩৭]
[2] মুসলিম, হাদিস: ২৬৬৯
[3] আবু দাউদ, তিরমিযি, হাদিস: ২৬৭৬
[4] বুখারি, হাদিস: ৬১১৬
[5] মুসলিম, হাদিস: ৪৯
[6] বুখারি, হাদিস: ৬০০৮
[7] মুসলিম, হাদিস: ১২৯৭
[8] মুসলিম, হাদিস: ১৭৭২
[9] বুখারি, হাদিস: ৬০০৮
[10] মুসলিম, হাদিস: ১২৯৭
[12] বুখারী, হাদিস:৭২৮৮, মুসলিম: 1337
[13] তিরমিযি, হাদিস: ২৬৭৬, ইবনু মাযা: ৪৭
[14] বুখারী, আস-সহীহ: ৬ / ২৬৫৫ / হাদিস নং- ৭২৮০
[15] [সূরা আন্-নাজম: ৩-৪]
[16] সূরা আহযাব, আয়াত: ৩৬
[17] সূরা নিসা: ৬৫
[18] বুখারি, হাদিস: ৭২৮০
[19] সূরা আনফাল, আয়াত: ১
[20] আল ইমরান: ৩৩
[21] সূরা আল হাশর: ৭
[22] আহমদ, হাদিস: ১৭১৭৪, আবুদ দাউদ হাদিস: ৪৬০৪
[23] সূরা নিসা, আয়াত: ৫৯
[24] সূরা আলু ঈমরান: ৩১
[25] সূরা নূর: ৬৩

[25] সূরা নূর: ৬৩
[26] সূরা আহযাব: ২১
[27] বুখারি, হাদিস: ৭২৮১
[28] তিরমিযি, ২৬৭৬ ইবনু মাযাহ, ৪২ আবু দাউদ, ৪৬০৭
[29] সূরা আল হুজরাত: ১
[30] সূরা আন্-নজম: ৩-৪
[31] আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬০৪
[32] বুখারি: ৮ মুসলিম: ১৬
[33] সূরা আল-বাকারাহ: ৮৩
[34] আল-বাকারাহ: ১৮৩
[35] আল-ইমরান: ৯৭
[36] সূরা আল-বাকারাহ: ৮৩
[37] সূরা আল-বাকারাহ্: ৮৩
[38] (বুখারী, ১৪৮৪ মুসলিম, ৯৭৯ নাসাঈ]।
[39] সূরা আল-বাকারাহ্: ১৮৩
[40] সূরা আল-ঈমরান: ৯৭
[41] সূরা আল-মায়িদা: ৬
[42] সূরা আল-মায়িদাহ্: ৩৮
[43] সূরা আন-নিসা: ২৪
[44] বুখারি, হাদিস: ৫১০৮, মুসলিম: 1408
[45] সূরা নিসা, আয়াত: ১১
[46] বুখারি, হাদিস: ৪০৩৫,
[47] বুখারি: ৬৭৬৪
[48] আহমদ: ৩৪৬, ইবনু মাযা: ২৬৪৫
[49] সূরা আল-মায়িদাহ: ৩৮
[50] মুসলিম, হাদিস: ১৩২২, নাসায়ী, হাদিস: ৪৯৪৬
[51] আবু দাউদ: ১৭১০
[52] সূরাহ আন-নাহল: ৪৪
[53] সূরা আন-নিসা, ৮০
[54] [সূরা আল-হাশর, ৭]
[55] [সূরা আন-নিসা, ৬৫]
[56] [সূরা আন্-নাহল, ৪৪]
[57] মুসলিম: ৩
[58] মুসলিম: ১০
[59] আহমদ: ১২৭৪৬
[60] মুসলিম: ৭
[61] বুখারি, আল-জুমআ, হাদিস: ৮৫৮, মুসলিম, সালাত, হাদিস: ৪৪২, তিরমিযি, জুমআ, হাদিস: ৫৭০, নাসায়ী, মাসাজেদ, ৭০৬, আবু দাউদ, সালাত হাদিস: ৫৬৮, ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৬, আহমদ: ১৬/২, দারমী, ৪৪২।
[62] বুখারি, আদব-হাদিস: ৫৮৬৬, মুসলিম, শিকার ও জবেহ অধ্যায় হাদিস: ১৯৫৪, নাসায়ী কাসামাহ, হাদিস: ৪৮১৫, ইবনে মাজাহ, শিকার অধ্যায়, ৩২২৭, আহমদ, হাদিস ৫৬/৫, দারমী মুকাদ্দিমা, হাদিস: ৪৪০
[63] তিরমিযি, ইলম অধ্যায়, হাদিস ২৬৬৪, আবুদ দাউদ, সূন্নাহ আধ্যায়, হাদিস: ৪৬০৪, ইবনু মাযাহ, মুকাদ্দিমাহ, হাদিস: ১২
[64] সূরা নূর, আয়াত: ৬৩
[65] -(সূরা আন-নিসা: ৫৯];
[66] সূরা নূর, আয়াত: ৬৩
[67] বুখারি সুলাহ অধ্যয়ি, হাদিস: ২৫৫০, মুসলিম বিচার ফায়সালাহ অধ্যায়, হাদিস: ১৭১৮, আবু দাউদ সূন্নাহ অধ্যায়, হাদিস, ৪৬০৬, ইবনু মাযাহ; মুকাদ্দিমাহ, হাদিস: ১৪, আহমদ, হাদিস: ২৫৬/৬
[68] বুখারি, রিকাক অধ্যায়, হাদিস: ৬১১৮, মুসলিম, ফাযায়েল অধ্যায়, হাদিস: ২২৪৪, তিরমিযি, আমসাল অধ্যায়, হাদিস: ২৮৭৪, আহমদ, হাদিস: ৩১২/২
_________________________________________________________________________________
সংকলন: জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

সূত্র: ইসলামহাউজ

আরও পড়ুনঃ রাসূল সাল্